ধর্ম কাকে বলে? ধর্ম শব্দের অর্থ কী? What is religion?

ধর্ম কাকে বলে? ধর্ম শব্দের অর্থ কী? What is religion?

 পৃথিবীতে অনেক প্রকার ধর্ম রয়েছে এবং এক এক জন এক এক রকম ভাবে ধর্মের সংঙ্গা প্রদান করে থাকে। আমরা সবাই  কোন না কোন ধর্ম যাজন করি কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না ধর্ম শব্দের অর্থ কি? তাই আজ এটাই আলোচনার বিষয়ঃ-

 

      "ধর্মং তু সাক্ষাদ্ ভগবদ প্রণীতম" (ভাগবত- ৬/৩/১৯)। স্বয়ং ভগবান কর্তৃক প্রণীত আইনকে ধর্ম বলে। প্রচলিত অর্থে ধর্ম বলতে কোনো বিশ্বাসকে বুঝায়। কিন্তু বিশ্বাস নিয়তই পরিবর্তিত হয়। তাই যা পরিবর্তিত হয় তাকে ধর্ম বলা যায় না। আবার ধর্ম বলতে বুঝায়, যা কোনো কিছুর অস্তিত্বকে ধারণ করে রাখে তাই ধর্ম। যদি তাই হয় তাহলে চোর তার চুরিবিদ্যাকে ধারণ করে রাখে যখন সে  চুরি করে তাহলে কেন তাকে তার অপকর্মের জন্য শাস্তি প্রদান করা হয়। অর্থাৎ এটিও যথাযথভাবে যুক্তি প্রদান করে না। 

 

      তাহলে ধর্ম কাকে বলে-? ধর্ম হলো এমন এক বস্তু যা বাদ দিলে ওই বস্তুর কোন অস্তিত্ব থাকে না। যেমন,জলের ধর্ম তরলতা। যদি জল থেকে তার তরলতাকে বাদ দেওয়া হয় তাহলে সেই জলের কোন অস্তিত্ব থাকবে না। তেমনি আগুনের ধর্ম তাপ। যদি আগুন থেকে তার তাপকে সরিয়ে নেওয়া হয় তাহলে আগুনের কোন অস্তিত্ব থাকবে না। 

 

      অর্থাৎ, ধর্ম হলো কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর স্বাভাবিক গুণ বা বৈশিষ্ট্য, যা ঐ ব্যক্তি বা বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। 

তাহলে আমরা এখন উপরের উদাহরণ থেকে মিলিয়ে দেখি এবং বাস্তবতার সাথে মিল খুঁজে দেখি ধর্ম কাকে বলে। এখন স্বভাবতই প্রশ্ন হতে পারে তাহলে মানুষের ধর্ম কি? 

আমরা ধর্মের সংজ্ঞা থেকে মানুষের ধর্ম কি তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করি ।মানুষের ভেতর থেকে কি এমন বাদ দিলে সেই মানুষটির কোন অস্তিত্ব থাকবে না আমরা একটু চিন্তা করে দেখি যে একজন মানুষ মৃত কখন বলা হয় যখন তার ভেতর থেকে আত্মা চলে যায় অর্থাৎ আত্মার অনুপস্থিতিতে সেই মানুষটি মৃত। তাহলে আমরা বলতে পারি আত্মা বিহীন মানুষের কোন অস্তিত্ব থাকে না তাই মানুষের ধর্ম হলো আত্মা।

 

 এখন প্রশ্ন হতে পারে মানুষের ধর্ম যদি আত্মা হয় তাহলে আত্মার ধর্ম কি? 

আমরা সেই সংজ্ঞার সঙ্গে মিল করে দেখি যে আত্মার ভেতর থেকে কি এমন বস্তু বাদ দিলে এই আত্মার কোন অস্তিত্ব থাকে না । শাস্ত্রে নিহিত রয়েছে আমরা হলাম স্বতন্ত্র জীব আত্মা যা পরমাত্মার ক্ষুদ্রতি ক্ষুদ্র অংশ সেই পরমাত্মার অনুপস্থিতিতে আত্মার কোন অস্তিত্ব থাকে না। মা হলো অনু আর পরমাত্মা হল বিভু তাই অণুর কর্তব্য হচ্ছে বিপুল সেবা করা। তাই সভাবতই আমরা বলতে পারি আত্মার ধর্ম হলো পরমাত্মা।

আলোচনা থেকে আমরা এটা বলতে পারি তাহলে মানুষের ধর্ম হলো পরমাত্মার সেবা করা। 

 

 আবার অনেকে সৎ পথে চলা, কারও ক্ষতি না করা, মিথ্যা না বলা, সমাজ সেবা, হিংসা না করা এগুলোকে ধর্ম বলে। মনে করে। কিন্তু মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, সত্য বলা উচিত কিন্তু তা লোকের প্রিয় হওয়া চাই। অপ্রিয় সত্য বলা উচিত নয়। আবার এও বলা হয়েছে, লোকের প্রীতিকর মিথ্যা বলা উচিত নয়। পাখি যেমন আকাশে চলার সময় তার চরণচিহ্ন রাখে না, মাছ যেমন জলে চরণচিহ্ন রাখে না তেমনি প্রকৃত ধর্মের গতি বোঝাও কঠিন। মহাভারত এই সমস্যার সমাধান দিয়ে বলেছে: 

 

    "ধর্মস্য তত্ত্বং নিহিতং গুহায়াং -

    মহাজনো যেন গতঃ স পন্থা”।।

    (মহাভারত, বন পর্ব- ৩১৩/১১৭)

অর্থাৎ ধর্ম তত্ত্ব গূঢ় রূপে আচ্ছাদিত হয়ে আছে। তাই সাধুরা যাদের মহাজন বলে স্থির করেছেন এবং মহাজনেরা যে পন্থাকে শাস্ত্র পন্থা বলেছেন সেই পথেই সকলের অনুগমন করা উচিত। মহাজন কারা ?

 

     "স্বয়ম্ভু নারদ: শম্ভুঃ কুমারঃ কপিলো মনুঃ

     প্রহ্লাদো জনকো ভীষ্মো বলি বৈয়াসকি বয়ম। (ভা: ৬/৩/২০)। 

অর্থাৎ শ্রী ব্রহ্মা, মহর্ষি নারদ, শ্রী শিব, চার কুমার,ভগবান কপিল দেব, স্বয়ম্ভুব মনু, প্রহ্লাদ মহারাজ, জনক মহারাজ, পিতামহ ভীষ্ম,বলি মহারাজ, শুকদেব গোস্বামী এবং যমরাজ এই দ্বাদশ মহাজন ধর্ম নীতি সম্বন্ধে অবগত। মহাজনদের উক্তি : ভীষ্ম দেব: হে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির, বসুদেব নন্দন শ্রীকৃষ্ণ যে নির্দেশ দিয়েছেন সেই নির্দেশ মতো চলাটাই একমাত্র ধর্ম। (মহাভারত)

 

     শ্রী ব্রহ্মা: জন্ম, মৃত্যু, বিভিন্ন রকমের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা সমন্বিত ভয়ঙ্কর অন্ধকারাচ্ছন্ন বিপদসংকুল জড় সংসার থেকে মুক্ত হওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবান শ্রী কৃষ্ণের প্রেমময়ী সেবায় যুক্ত হওয়া। (স্কন্দ পুরান) 

শ্রী শিব: হে নারদ সংসারে যত মত আছে, যত মন্ত্র আছে, যত কর্ম আছে সে সমস্ত কিছুর সারৎসার, সমস্ত কর্ম চক্রের মুক্তির পন্থা হচ্ছে একমাত্র পরমেশ্বর ভগবান শ্রী কৃষ্ণের পাদপদ্ম সেবা।

 

       অপ্রাকৃত বিশুদ্ধ অন্তঃকরণই বসুদেব শব্দের দ্বারা অভিহিত। আবরণশূন্য পুরুষ সেই বিশুদ্ধ অন্তঃকরণে প্রকাশিতন বলিয়া তাঁহার নাম বাসুদেব। তিনি ইন্দ্রিয়জাত জ্ঞানের অতীত। বাসুদেব সেবোন্মুখচিত্তে নিত্য প্রকাশমান। আমি সেই ভগবান বাসুদেবকে সতত বিশেষরূপে প্রণাম জানাই। (ভাঃ ৪/৩/২৩) 

 

নারদ মুনি: পদ্ম পলাশলোচন শ্রীকৃষ্ণের অর্চনা যে নরাধম না করে, যে তাহাতে বাধা দেয়, সে জীবন্তে মৃত; তাহার মুখদর্শনও করতে নাই। (মহাভারত) 

 

সুতরাং মহাজনদের প্রদর্শিত পন্থা এক অর্থাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের স্মরণ গ্রহণ করা, তাঁর সেবা করা এবং তাঁর নির্দেশিত পথ অবলম্বন করা, আর এটাই হচ্ছে প্রকৃত ধর্ম । ভগবান গীতাতে বলেছেন, 

 

      মনুনা ভব মন্ত্ৰতো মদ যাজী মাং নমস্কুরু।

      মামেবৈষ্যসি সত্যং তে প্রতি জানে প্রিয়হসি মে।। (গীতা- ১৮/৬৫)। 

 

অর্থাৎ শ্রী কৃষ্ণ বলছেন, আমাতে চিত্ত অর্পণ কর, আমার ভক্ত হও, আমার পূজা কর, আমাকে নমস্কার কর। তা হলে তুমি আমাকে অবশ্যই প্রাপ্ত হবে। এই জন্য আমি তোমার কাছে সত্যই প্রতিজ্ঞা করছি, যেহেতু তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয়। এই পন্থা অবলম্বন অর্থাৎ ভগবান যে আইন দিয়েছেন তা পালন করা, তা পালনের যেন কোনো উদ্দেশ্য না থাকে এবং তা যাতে কোনো কিছুর দ্বারা প্রতিহত না হয় তাই হচ্ছে প্রকৃত ধর্ম।