হােলি বা দোল উৎসব এর সঠিক ইতিহাস কি? দোল পূর্নিমা কি ? হোলি উৎসব কি?
হোলির দিনে সবাব রং খেলায় রঙ্গিন হয়ে ছবি তুলে বিভিন্ন ভাবে পােস্ট দিচ্ছে। কিন্তু হােলি কি? কেন? এ প্রশ্নগুলাে কি কারাে মাথাতেই খেলছে না? বর্তমান সময়ে রঙের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, বিপরীত লিঙ্গ মানুষের মাখামাখি এমনকি শ্রীকৃষ্ণ রাধার হােলি মাখা ছবিগুলাে দেখে অনেকেই বলেছেন এর নামই কি হােলি?
আসুন আজ জেনে নেয়া যাক হোলি বা দোল উৎসবের উৎপত্তি কোথা থেকে-
ভাগবত পুরাণের সপ্তম অধ্যায়ে বর্নিত রয়েছে-দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু অমর হতে চেয়েছিলেন- এজন্য ব্রহ্মার নিকট হতে অমরত্বের বর প্রাপ্তির জন্য তিনি কঠোর তপস্যা করেন ।এতে হিরণ্যকশিপু সু-কৌশলে এমন বর চান যাতে তার মনে হয় যেন পরোক্ষভাবে তিনি অমরত্ব লাভ করেছেন। তিনি ব্রহ্মার কাছ থেকে যেসব বর লাভ করেছেন সেগুলো হলো তাকে মানুষ হত্যা করতে পারবে না, কোন প্রাণীও তাকে হত্যা করতে পারবে না, তাকে ঘরে বা বাইরেও হত্যা করতে পারবে না , তাকে দিনে ও রাতেও হত্যা করতে পারবে না, কোন অস্ত্রের দ্বারাও তাকে হত্যা করা যাবে না আবার সস্ত্রের দাড়াও হত্যা করা যাবে না, তাকে স্থুল, জল, বা বায়ু কোথাও তাকে হত্যা করা যাবে না। এই বর লাভ করে সে অহংকারী হয়ে ওঠে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে কেবল তাকেই ভগবান হিসেবে পূজা করা হবে ।কেউ তার আদেশ পালন না করলে তিনি তাকে শাস্তি দেবেন বা হত্যা করবেন। কিন্তু তার ঘরে এক বিষ্ণু ভক্তের জন্ম হয় তার নাম ভক্ত প্রহ্লাদ। প্রহ্লাদ তার বাবা হিরণ্যশিপুর কোথায় সম্মতি হননি । কারন সে ছিল এক বিষ্ণু ভক্ত তার পিতা কে ভগবান হিসেবে পূজা করতে তিনি অস্বীকার করেন। এতে হিরণ্যকশিপু খুব রাগান্বিত হন এবং প্রহ্লাদকে হত্যা করার বিভিন্ন চেষ্টা করেন কিন্তু শত চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। তখন হিরণ্যকশিপু তার বোন হোলিকার কাছে সাহায্য চান। তখন হোলিকা প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে আগুনে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত নেন কারণ হোলিকা এই বর পেয়েছিল যে আগুনে তার কোন ক্ষতি হবে না। কিন্তু অন্যায় কাজের শক্তি প্রয়োগ করায় হোলিকা প্রহ্লাদকে নিয়ে আগুনে প্রবেশ করলে ভগবান বিষ্ণুর কৃপায় প্রহ্লাদ অগ্নিকুণ্ডে অক্ষত থেকে যায় এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে হোলিকার বর নষ্ট হয়ে যায় এবং হোলিকা পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যায় এই হোলিকা থেকেই হোলি কথাটির উৎপত্তি।
অন্যদিক বসন্তের পূর্ণিমার এই দিনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কেশি নামক অসুরকে বধ করেন। কোথাও কোথাও অরিষ্টাসুর নামক অসুর বধের কথাও আছে। অন্যায়কারী, অত্যাচারী এই অসুরকে বধ করার পর সকলে আনন্দ করে। এই অন্যায় শক্তিকে ধ্বংসের আনন্দ মহাআনন্দে পরিণত হয়।
অঞ্চল ভেদে হােলি বা দোল উদযাপনের ভিন্ন ব্যাখ্যা কিংবা এর সঙ্গে সংপৃক্ত লােককথার ভিন্নতা থাকতে পারে কিন্তু উদযাপনের রীতি এক।বাংলায় আমরা বলি 'দোলযাত্রা' আর পশ্চিম ও মধ্যভারতে 'হােলি',। রঙ উৎসবের আগের দিন 'হােলিকা দহন' হয় অত্যন্ত ধুমধাম করে। শুকনাে গাছের ডাল, কাঠ ইত্যাদি দাহ্যবস্তু অনেক আগে থেকে সংগ্রহ করে সু-উচ্চ একতা থাম বানিয়ে তাতে অগ্নি সংযােগ করে 'হােলিকা দহন হয়। পরের দিন রঙ খেলা। বাংলাতেও দোলের আগের দিন এইরকম হয় যদিও তার ব্যাপকতা কম - আমরা বলি 'চাঁচর। এই চাঁচরেরও অন্যেরকম ব্যাখ্যা আছে। দোল আমাদের ঋতুচক্রের শেষ উৎসব। পাতাঝরার সময়, বৈশাখের প্রতীক্ষা। এই সময় পড়ে থাকা গাছের শুকনাে পাতা, তার ডালপালা একত্রিত করে জ্বালিয়ে দেওয়ার মধ্যে এক সামাজিক তাৎপর্য রয়েছে। পুরনাে জঞ্জাল, রুক্ষতা, শুষ্কতা সরিয়ে নতুনের আহ্বান হচ্ছে। এই হােলি। বাংলায় দোলের আগের দিন 'চাঁচর উদযাপনকে এভাবেই ব্যাখ্যা করা হয়।
আমাদের অনেক ধর্মীয় উৎসবেই আঞ্চলিক লােক সংস্কৃতি ও রীতির প্রভাব দেখা যায়, হােলিও তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলার দোলযাত্রায় গৌড়ীয় বৈষ্ণব রীতির প্রাধান্য পায়। ঐতিহাসিকরা বিশ্বাস করেন পূর্বভারতে আর্যরা এই উৎসব পালন করতেন। যুগে যুগে এর উদযাপন রীতি পরিবর্তিত হয়ে এসেছে। পুরাকালে বিবাহিত নারী তার পরিবারের মঙ্গল কামনায় রাকা পূর্ণিমায় রঙের উৎসব করতেন।
বর্তমানে এই হোলি উৎসব সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে অতি পরিচিত একটি উৎসব হয়ে উঠেছে। এই হোলি উৎসব বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামে পরিচিতি লাভ করেছে। হোলি পশ্চিমবঙ্গে এবং আসামে বসন্ত উৎসব নামে পরিচিত। আবার আসামে রং এর উৎসব বা দোলযাত্রা নামে। নেপালের পাহাড়ি অঞ্চলে ফাগু পূর্ণিমা। উড়িষ্যায় দোলযাত্রা এবং ভোজপুরিতে ফাগুয়া নামেও পরিচিত।
ব্রজ অঞ্চলে হোলির বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে যার মধ্যে রয়েছে ঐতিহগতভাবে রাধাকৃষ্ণের সাথে যুক্ত স্থান গুলি মথুরা বৃন্দাবন নন্দগাঁও বারসনা এবং গোকুল যা হলির মৌসুমে পর্যটন হয়ে ওঠে। ভারত ও নেপালের বাইরে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই আজ এই হোলি উৎসব পালিত হচ্ছে।
দোল হিন্দু সভ্যতার অন্যতম প্রাচীন উৎসব। নারদ পুরাণ, ভবিষ্য পুরাণ ও জৈমিনি মীমাংশায় রঙ উৎসবের বিবরণ পাওয়া যায়। ৩০০ খৃষ্টপূর্বাব্দের এক শিলালিপিতে রাজা হর্ষবর্ধন কর্তৃক 'হেলিকোৎসব'পালনরে উল্লেখ পাওয়া যায়।হর্ষবর্ধনের নাটক 'রত্নাবলী'তেও হােলিকোৎসবের উল্লেখ আছে। এমনকি আল বেরুণীর বিবরণে জানা যায় মধ্যযুগে কোন কোন অঞ্চলে মুসলমানরাও হােলিকোৎসবে সংযুক্ত হতেন।
মধ্যযুগের বিখ্যাত চিত্রশিল্পগুলির অন্যতম প্রধান বিষয় রাধা-কৃষ্ণের রঙ উৎসব। এই রাধা-কৃষ্ণকে কেন্দ্র করে হােলির যে অতি বৈষ্ণবীয় আচার তা অবশ্যই প্রশ্নযুক্ত। শ্রীকৃষ্ণের ঝুলন থেকে দোল কথার উদ্ভব।
সে যাই হােক রাধা-কৃষ্ণ তত্ত্বকে দাড় করিয়ে বিপরীত লিঙ্গের মাঝে অবাধ হােলি খেলা অবশ্যই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সমর্থন যােগ্য নয়। আবার বিষাক্ত রঙের ব্যবহারও উচিত নয়। এমনকি বহু জায়গায় হােলিকা দহনের নামে গাছপালা যথেচ্ছ কেটে ফেলা হয় তাও উচিত নয়। তাই হােলি নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের অসামাজিকতা পরিহার করা জরুরী।
হােলি সম্পর্কে বড় একটি তথ্য সকলে এড়িয়ে যায়। ধর্ম ও সমাজ ওতাে প্রােত ভাবে জড়িত। আর একটি উৎসব বা দিন আরও পবিত্র হয়ে ওঠে যদি উক্ত দিনে পৃথিবী মহান পুরুষের জন্ম দেয়। বাঙালি তথা হিন্দু সমাজের অন্যতম প্রাণপুরুষ শ্রীচৈতন্যের জন্মতিথি হচ্ছে এই পূর্ণিমা তিথি তথা হােলি তিথি। এই মহান পুরুষের জন্ম উৎসবের মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
অন্যায়কে পরাজিত করার আনন্দে সকলের মন রাঙিয়ে উঠুক। ভগবানের আবির্ভাবে সকলের মন আনন্দে নেচে উঠুক। অবশ্যই অসামজিকতায় নয়। অশুভকে বিনাশ করে শুভ শক্তির জয় উদযাপনই হোলি উৎসব রঙের পাশাপাশি তাই ন্যাড়া পোড়াকেও সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়। যা নিয়ে বাংলায় মজার ছড়াও প্রচলিত,
'আজ আমাদের ন্যাড়া পোড়া কাল আমাদের দোল,।
পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে বল হরি বোল।' ।।
হোলির একদিন আগে অনুষ্ঠিত হয় হলিকা দহন। তার জন্য আগে থেকে শুকনো ডাল, কাঠ এবং শুকনো পাতা জোগাড় করা হয়। তারপরে ফাগুন পূর্ণিমার সন্ধ্যায় পোড়ানো হয় সমস্ত স্তূপাকার করে। এই দহন অশুভ শক্তি বিনাশের প্রতীক।