কার্তিক বা দামোদর মাসে দীপদানের মাহাত্ম্য। শ্রীহরির উদ্দেশ্যে প্রদীপ দানে সমস্ত পাপ হতে মুক্তি। Dipdan Mahatma

কার্তিক বা দামোদর মাসে দীপদানের মাহাত্ম্য। শ্রীহরির উদ্দেশ্যে প্রদীপ দানে সমস্ত পাপ হতে মুক্তি। Dipdan Mahatma

কার্তিক বা দামোদর মাসে বিভিন্ন ব্রতের অঙ্গসমূহের মধ্যে ভগবান দামোদরকে দীপদানের মাহাত্ম্য অনেক কারণ আমরা ভগবানের উদ্দেশ্যে যা কিছুই করি না কেন এই সব কিছুর একটাই উদ্দেশ্য তা হল ভগবানকে খুশি করা কিন্তু যদি কেউ এই দামোদর মাসে ভগবানের উদ্দেশ্যে দ্বিপদান করে সে তৎক্ষণাৎ ভগবানের অতীব প্রিয় হয়ে যান। 

 

       শ্রীশ্রীরাধা-দামোদরের সন্তুষ্টির জন্য এ মাসে প্রতিদিন সন্ধ্যায় ঘৃত প্রদীপ নিবেদন করা কর্তব্য। সামর্থ্য থাকলে ঘৃত-প্রদীপ, নতুবা তিলের তেলের প্রদীপ নিবেদন করা কর্তব্য। কার্তিক মাসে ভগবানকে দীপদান এতই গুরুত্বপূর্ণ যে শাস্ত্রে বলা হয়েছে

 

হরিভক্তিবিলাস গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে- 

 

         নির্ধেনেনাপি বিপ্রেন্দ্র কৃত্বা ৰৈ চাত্মবিক্ৰয়ম্ ।

         কর্তব্যং দীপদানন্তু যাবৎ কার্তিক-পূর্ণিমা।

 

অনুবাদঃ হে বিপ্রেন্দ্র, দরিদ্র নির্ধন ব্যক্তিরও আত্মবিক্রয় করে কার্তিক পূর্ণিমা যাবৎ দীপদান কর্তব্য। ত্রিভুবনে এমন কোনো পাতক নেই, যা কার্তিকে শ্রীকেশবদেবের অগ্রে দীপদান শোধন করতে পারে না। হরিভক্তিবিলাস (১৬/১২১)

 

পদ্মপুরাণে বর্ণিত হয়েছে, দীপাবলির দিন শ্রীশ্রীসীতা-রামচন্দ্র এবং শ্রীশ্রীলক্ষ্মী-নারায়ণের প্রীতির উদ্দেশ্যে দীপদান কর্তব্য। দীপদানের মাহাত্ম্য সম্বন্ধে

হরিভক্তিবিলাস ধৃত ক্ষান্দবক্য-

 

         কল্পকোটিসহস্রাণি পাতকানি বহুনাপি।

      নিমেষার্ধেন দীপস্য বিলয়ং যান্তি কার্তিকে ॥

 

    অর্থাৎ, হে দেবর্ষি যারা সহস্র সহস্র পাপেও পাতকী, তারাও যদি কার্তিক মাসে শ্রীহরির উদ্দেশ্যে প্রদীপ নিবেদন করেন, তবে তারাও সমস্ত পাপ হতে মুক্ত হবেন।

হরিভক্তিবিলাস (১৬/১৯)

 

যারা নিজে দীপদান করতে পারেন না, তারা যদি অন্যের প্রদত্ত প্রদীপকে প্রবোধিত করেন, অর্থাৎ নিতু নিতু প্রদীপের সলতে বাড়িয়ে দিয়ে আরো উজ্জ্বল করে তোলেন, তারাও শ্রীহরির প্রিয় হন।

 

 

 

আরো বর্ণিত হয়েছে-

 

        বোধনাৎ পরদীপস্য বৈষ্ণবানাঞ্চ সেবনাৎ

        কার্তিকে ফলমাপ্লোতি রাজসূয়াশ্বমেধয়োঃ !

        ন তত্ত্ববতি বিপ্রেন্দ্র ইষ্টেরপি মহামখৈঃ 

        কার্তিকে যৎ ফলং প্রোক্তং পদীপপ্রবোধনাৎ!

 

          অর্থাৎ, কার্তিক মাসে অন্যের প্রজ্বলিত প্রদীপ প্রবোধিত করলে যে ফল হয়, ইষ্টাদি মহাযজ্ঞ সাধনেও সে ফল লাভ সম্ভব হয় না। অন্যের প্রদত্ত দীপ প্রবোধন এবং বৈষ্ণবগণের সেবার দ্বারা রাজসূয় এবং অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল লাভ হয়। একবার একটি ইঁদুর কার্তিক মাসে একাদশীতে মন্দিরে প্রজ্বলিত প্রদীপের ঘি খাওয়ার সময় অজান্তেই দীপের ঔজ্জ্বল্য বাড়িয়ে দেয়; আর এর ফলে সে ভগবদ্ধাম প্রাপ্ত হয়।

 

ব্রহ্মা নারদ সংবাদ-

        ব্রহ্মা  নারদকে বললেন- হে নারদ, এখন আকাশ দীপের মহিমা শ্রবণ কর। কার্তিক মাস আগত হলে যিনি নিয়মিত ব্রাহ্মমুহূর্তে স্নান করে আকাশদীপ দান করেন তিনি সমস্ত লোকের আধিপত্য এবং অন্তে মোক্ষ লাভ করেন। এজন্য কার্তিক মাসে স্নান, দান আদি কর্ম করার পাশাপাশি ভগবান বিষ্ণুর মন্দিরে এই একমাস দীপদান করা অবশ্য কর্তব্য । মহারাজ সুনন্দন চন্দ্রশর্মা নামক ব্রাহ্মণের পরামর্শ অনুসারে এই একমাস বিধিপূর্বক ব্রত অনুষ্ঠান করেছিলেন। কার্তিক মাসে প্রতিদিন প্রাতঃস্নান করে পবিত্র হয়ে কোমল তুলসীদল দ্বারা ভগবান বিষ্ণুর পূজা এবং রাতে আকাশ দীপ দিতেন। দীপ প্রদানের সময় তিনি এই মন্ত্র পাঠ করতেন-

 

           দামোদরায় বিশ্বায় বিশ্বরূপধরায় চ। 

        নমস্কৃত্যা প্রদাস্যামি ব্যোমদীপং হরিপ্রিয়ম্ ॥

 

   “আমি সবেশ্বর এবং বিশ্বরূপধারী ভগবান দামোদরকে নমস্কার করে এই আকাশদীপ প্রদান করছি, যা ভগবানের পরম প্রিয়। হে দেবেশ্বর, এই ব্রতের ফলে যেন আপনার প্রতি আমার ভক্তি বর্ধিত হয়।"

 

 

        এভাবে প্রার্থনা করে রাজা সুনন্দন দীপদান করতেন। ব্রাহ্মমুহূর্তে উঠে পুনর্বার আকাশদীপ দিতেন। এভাবে তাঁর প্রাতঃস্নান এবং ভগবান বিষ্ণুর পূজা নিয়মিত চলতে লাগল। মাস শেষে ব্রতভঙ্গ করে আকাশ দীপের নিয়মের সমাপ্তি করলেন এবং ব্রাহ্মণ ভোজন করিয়ে এই বিষ্ণুব্রত পূর্ণ করলেন। এই পুণ্যের প্রভাবে রাজা এই পার্থিব জগতেই স্ত্রী-পুত্র-পৌত্র এবং আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে এক লক্ষ বৎসর সুখ উপভোগ করলেন এবং অন্তকালে পত্নীসহ সুন্দর বিমানে আরূঢ় হয়ে চতুর্ভুজ (শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম দ্বারা সুশোভিত) বিষ্ণুসারূপ্য লাভ করে মোক্ষ প্রাপ্ত হলেন।

 

অতএব, দুর্লভ মনুষ্য জন্ম লাভ করে ভগবান বিষ্ণুর অত্যন্ত প্রিয় আকাশদীপ বিধিপূর্বক দান করা উচিত। এই সংসারে যে বিষ্ণুর প্রসন্নতা বিধানের জন্য আকাশদীপ প্রদান করে, তাকে ক্রুর মুখবিশিষ্ট যমরাজের মুখ দর্শন করতে হয় না। একাদশীতে সূর্যের তুলারাশিতে অবস্থান অথবা পূর্ণিমাতে লক্ষ্মী সহিত ভগবান বিষ্ণুর প্রসন্নতা বিধানের জন্যই আকাশদীপ প্রদান করা চাই।

 

       নমো পিতৃভ্যঃ প্রেতেভ্যো নমো ধর্মায় বিষ্ণবে। 

           নমো যমায় রুদ্রায় কান্তারপতয়ে নমঃ

 

“প্রেতলোকগত পিতৃগণকে নমস্কার, ধর্মস্বরূপ বিষ্ণুকে প্রণাম, যমরাজকে নমস্কার, দুর্গম পথে রক্ষাকারী ইন্দ্রকেও নমস্কার।"

 

এই মন্ত্র উচ্চারণ করে যে মানুষ পিতৃগণের নিমিত্ত আকাশে দীপদান করেন, তার পিতৃগণ নরকে থাকলেও উত্তম গতি প্রাপ্ত হন। যে দেবালয়ে, নদীর তীরে, রাজপথে, নিদ্রা যাবার স্থানে দীপদান করে সে ধনৈশ্বর্য প্রাপ্ত হয়। যে ব্রাহ্মণ বা অন্যজাতির মন্দিরে দীপ প্রজ্জ্বলন করে সে বিষ্ণুলোকে অধিষ্ঠিত হয়। যে কণ্টকাকীর্ণ দুর্গম উঁচু-নিচু পথে দীপ দান করে সে কখনো নরকে পতিত হয় না। পূর্বকালে রাজা ধর্মনন্দন আকাশদীপ দানের প্রভাবে শ্রেষ্ঠ বিমানে আরোহণ করে বিষ্ণুলোকে প্রস্থান করেছিলেন।

 

যিনি কার্তিক মাসে হরিবোর্ধিনি একাদশীতে ভগবান বিষ্ণুর সম্মুখে কর্পূর দিয়ে দীপ প্রজ্জ্বলন করেন তাঁর কুলে উৎপন্ন সমস্ত মানুষ ভগবান বিষ্ণুর প্রিয় ভক্ত হন এবং অন্তকালে মোক্ষলাভ করেন। পূর্বকালে কোনো এক গোপ অমাবস্যা তিথিতে ভগবানের মন্দিরে দীপ প্রজ্জ্বলন করে বারংবার জয়ধ্বনি উচ্চারণ করে রাজরাজেশ্বর হয়েছিলেন। 

 

এভাবে স্বয়ং ব্রহ্মা নারদ মুনির কাছে কার্তিক মাসে ভগবানের উদ্দেশ্যে নিয়মিত দীপ দান ও আকাশদীপ দানের মহিমা ব্যক্ত করেছিলেন । সকলেরই এভাবে কার্তিক মাসে দীপদান করা উচিত।

 

অতএব আমরা যদি ভগবানের প্রিয় হতে চাই এবং অন্তিমে ভগবানের কাছে ফিরে যেতে চাই তবে এই কার্তিক মাসে যদি কেউ ভগবানের উদ্দেশ্যে দীপদান করে এবং মহিমা শ্রবণ কীর্তন করে তবে সে অনায়াসে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। তাই আমাদের সকলের উচিত কার্তিক ব্রত পালন করা এবং কার্তিক মাসে ভগবানের উদ্দেশ্য দীপদান করা । হরে কৃষ্ণ-