কার্তিক মাসে দীপদান, আকাশ প্রদীপ, তুলসী কাষ্ঠের দীপদানের মহিমা। দামোদর মাসে কি কি করনিয়-
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই দামোদর বা কার্তিক মাস অতি প্রিয় কারণ এই মাসে ভগবান বিভিন্ন লীলা বিলাস করেছেন। তাই ভগবানের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য সাধু মহাত্মারা তপস্যা করে থাকেন । বিশেষ করে এই মাসে ভগবান দামোদরকে দীপদান, আকাশ প্রদীপ, তুলসী কাষ্ঠ দিয়ে দীপদান করে থাকেন। আজকে আমরা আলোচনা করব- দীপদান, আকাশ প্রদীপ, এবং তুলসী কাষ্ঠ দিয়ে দীপদান করলে কি হয় ।
দীপদানের মহিমা
শ্রীশ্রীরাধা-দামোদরের সন্তুষ্টির জন্য এ মাসে প্রতিদিন সন্ধ্যায় ঘৃত প্রদীপ নিবেদন করা কর্তব্য। সামর্থ্য থাকলে ঘৃত-প্রদীপ, নতুবা তিলের তেলের প্রদীপ নিবেদন করা কর্তব্য। কার্তিক মাসে ভগবানকে দীপদান এতই গুরুত্বপূর্ণ যে শাস্ত্রে বলা হয়েছে
হরিভক্তিবিলাস গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে-
নির্ধেনেনাপি বিপ্রেন্দ্র কৃত্বা ৰৈ চাত্মবিক্ৰয়ম্ ।
কর্তব্যং দীপদানন্তু যাবৎ কার্তিক-পূর্ণিমা।
অনুবাদঃ হে বিপ্রেন্দ্র, দরিদ্র নির্ধন ব্যক্তিরও আত্মবিক্রয় করে কার্তিক পূর্ণিমা যাবৎ দীপদান কর্তব্য। ত্রিভুবনে এমন কোনো পাতক নেই, যা কার্তিকে শ্রীকেশবদেবের অগ্রে দীপদান শোধন করতে পারে না। হরিভক্তিবিলাস (১৬/১২১)
পদ্মপুরাণে বর্ণিত হয়েছে, দীপাবলির দিন শ্রীশ্রীসীতা-রামচন্দ্র এবং শ্রীশ্রীলক্ষ্মী-নারায়ণের প্রীতির উদ্দেশ্যে দীপদান কর্তব্য। দীপদানের মাহাত্ম্য সম্বন্ধে
হরিভক্তিবিলাস গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে-
কল্পকোটিসহস্রাণি পাতকানি বহুনাপি।
নিমেষার্ধেন দীপস্য বিলয়ং যান্তি কার্তিকে ॥
অর্থাৎ, হে দেবর্ষি যারা সহস্র সহস্র পাপেও পাতকী, তারাও যদি কার্তিক মাসে শ্রীহরির উদ্দেশ্যে প্রদীপ নিবেদন করেন, তবে তারাও সমস্ত পাপ হতে মুক্ত হবেন।
হরিভক্তিবিলাস (১৬/১৯)
যারা নিজে দীপদান করতে পারেন না, তারা যদি অন্যের প্রদত্ত প্রদীপকে প্রবোধিত করেন, অর্থাৎ নিতু নিতু প্রদীপের সলতে বাড়িয়ে দিয়ে আরো উজ্জ্বল করে তোলেন, তারাও শ্রীহরির প্রিয় হন।
আরো বর্ণিত হয়েছে-
বোধনাৎ পরদীপস্য বৈষ্ণবানাঞ্চ সেবনাৎ। কার্তিকে ফলমাপ্লোতি রাজসূয়াশ্বমেধয়োঃ ন তত্ত্ববতি বিপ্রেন্দ্র ইষ্টেরপি মহামথ্যৈ কার্তিকে যৎ ফলং প্রোক্তং পরদীপপ্রবোধন
অর্থাৎ, কার্তিক মাসে অন্যের প্রজ্বলিত প্রদীপ প্রবোধিত করলে যে ফল হয়, ইষ্টাদি মহাযজ্ঞ সাধনেও সে ফল লাভ সম্ভব হয় না। অন্যের প্রদত্ত দীপ প্রবোধন এবং বৈষ্ণবগণের সেবার দ্বারা রাজসূয় এবং অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল লাভ হয়। একবার একটি ইঁদুর কার্তিক মাসে একাদশীতে মন্দিরে প্রজ্বলিত প্রদীপের ঘি খাওয়ার সময় অজান্তেই দীপের ঔজ্জ্বল্য বাড়িয়ে দেয়; আর এর ফলে সে ভগবদ্ধাম প্রাপ্ত হয়।
হরিভক্তিবিলাস (১৬/১২৬, ১২৮)
আকাশদীপ মহিমা-
এ সময় ভগবানের শ্রীমন্দিরের শিখরে প্রদীপ প্রদান এবং মন্দির প্রদীপ দিয়ে সজ্জিত করার অনন্ত মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে-
যদা যদা ভাসয়তে দীপকঃ কলসোপরি
তদা তদা মুনিশ্রেষ্ঠ দ্রব্যতে পাপসঞ্চয়ঃ॥
যো দদাতি দ্বিজাতিভ্যো মহীমুদধিমেঘলাম।
হকে শিখরদীপস্য কলাং নাইতি ষোড়শীম
অর্থাৎ, শ্রীহরির মন্দিরের শিখরে যখন যখন দীপ দেওয়া হয়, তখন তখন পাপরাশি দ্রবীভূত হয়। শুদ্ধ ব্রাহ্মণকে সমগ্র পৃথিবী দান করলে যত পুণ্য হয় তা মন্দিরের উপরে প্রদীপ দানের ষোল ভাগের এক ভাগও নয়।
হরিভক্তিবিলাস (১৬/১৩০-১৩১)
দীপপংক্তেশ্চ রচনাং সবাহ্যাভ্যন্তরে হরেঃ।
বিষ্ণোবিমানে কুরুতে স নরা শঙ্খচক্রবৃক্ !
বিষ্ণোবিমানং দীপাঢ্যং সবাহ্যাভ্যন্তরে মুনে।
দীপদ্যোতকরে মার্গে তেন প্রাপ্তং পরং পদম্
অর্থাৎ, যিনি বিষ্ণুমন্দিরের ভিতরে এবং বাইরে দীপমালা রচনা করেন,তিনি শ্রীবিষ্ণুর পার্ষদ। তাঁর ভগবদ্ধাম গমনকালে পথে দেবগণ দীপ হাতে করে অপেক্ষা করতে থাকেন। হরিভক্তিবিলাস (১৬/১৩৮, ১৪০ )
পদ্মপুরাণে বর্ণিত হয়েছে, কেউ যদি ভগবান শ্রীদামোদরের উদ্দেশ্যে আকাশদীপ এবং জলে প্রদীপ প্রদান করেন, তিনি ধন-ধান্যবান, সমৃদ্ধিশালী, সুপুত্র ও ঐশ্বর্যবান হন। এছাড়াও পথে, বৈষ্ণবগৃহে, তরুমূলে, গোশালায়, দুর্গম বনপথে শ্রীহরির প্রীতির উদ্দেশ্যে প্রদীপ প্রদান করলে মহাফল লাভ হয়। সমগ্র কার্তিক মাস তথা দামোদর মাসে মাষকলাই ডাল এবং আমিষাহার বর্জন করে ভগবান শ্রীদামোদরের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে প্রদীপ প্রদান করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যার মাধ্যমে মানুষসহ সকল জীবই ভগবানের অপ্রাকৃত করুণা প্রাপ্ত হতে পারে। সমগ্র কার্তিকে দীপদানের মহিমা কীর্তিত হয়েছে। তবে একাদশী এবং দীপাবলিতে প্রদীপদান আরো বিশেষভাবে মহিমান্বিত হয়েছে।
তুলসীকঠের দীপদান
তুলসী শ্রীহরিবল্পতা। এই মাসে প্রতিদিন তুলসী দ্বারা দামোদরের অর্চন কর্তব্য। সেই সাথে শুষ্ক তুলসী কাষ্ঠের দীপ ভগবানকে নিবেদন করা যায়।
হরিভক্তিবিলাস ধৃত প্রহ্লাদ সংহিতায় উল্লেখ আছে-
তুলসী পাবকেনৈৰ দীপং যঃ কুরুতে হবে।
দীপলক্ষসহস্রাণাং পুণ্যং ভবতি দৈত্যজঃ
অনুবাদ: হে দৈত্য কুমার, যিনি তুলসীকাষ্ঠের অগ্নিদ্বারা শ্রীহরিকে দীপদান করেন, তিনি সহস্র লক্ষ দীপদানের ফলভাগী হন। হরিভক্তিবিলাস (৮/৫৪)
উপরের আলোচনা থেকে আমরা এটা বুঝতে পারি যে যদি কেউ এই দামোদর বা কার্তিক মাসে ভগবানের উদ্দেশ্যে প্রতিদিন ঘৃত প্রদীপ, আকাশ প্রদীপ নিবেদন করে অথবা তুলসী কাঠ দিয়ে প্রদীপ বানিয়ে ভগবানের উদ্দেশ্যে নিবেদন করে তাহলে সে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হয়ে কৃষ্ণ প্রেম লাভ করে ভগবানের ধামে প্রবেশ করবে ।