কিভাবে পালন করব পুরুষোত্তম মাস। পুরুষোত্তম মাস পালনের নিয়মাবলীঃ Purushottam month
স্মাতবাদী পণ্ডিতেরা অধিমাসকে ‘মলমাস’ বা ‘মলিনমাস' বলে ঘৃণা করে। কিন্তু পরমার্থ শাস্ত্র এই অধিমাসটিকে সর্বোপরি শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা করেছে। জীবনের কোন অংশেই বৃথা যাপন করা উচিত নয়। সর্বদা হরিভজন করাই জীবনের কর্তব্য। আবার যেহেতু এই মাসটি সকল প্রকার কর্মশূন্য, তাই সেটি হরিভজনের জন্য অধিক উপযোগী। গোলোকাধিপতি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং এই মাসকে কার্তিক, মাঘ ও বৈশাখ আদি মহাপুণ্য মাস অপেক্ষা সর্বশ্রেষ্ঠ মাস বলে স্থাপন করেছেন। তাই আজকে আমরা আলোচনা করব পুরুষোত্তম মাস আমরা কিভাবে পালন করব।
পুরুষোত্তম মাস পালনের নিয়মাবলীঃ
* >>সর্বপ্রকার মৎস্য ও আমিষ, মাংস, মধু, কুলকর্কটীফল, সরিষা এবং সমস্ত মাদকদ্রব্য পরিত্যাগ করবে।
*>>দ্বিদল অর্থাৎ ছোলা ডাল, তিল, তৈল, কাঁকরযুক্ত অন্ন, ভাবদুষ্ট, ক্রিয়াদুষ্ট ও শব্দদুষ্ট দ্রব্য সকল বর্জন করবে। পরান্ন ভোজন, পরদ্রোহ, পরদার গমন, পরিত্যাগ করবে।
*>>পুরুষোত্তম মাসে দেবতা, বেদ, গুরু, গো, ব্রতী, স্ত্রীলোক, রাজা ও মহাজনের নিন্দা পরিত্যাগ করবে। জন্তুর অঙ্গোদ্ভূত চূর্ণ আমিষ ও ফলের মধ্যে জম্বীর অর্থাৎ গোঁড়ালেবু-আমিষ। ধান্যের মধ্যে মসূরিকা ও পর্য্যসিত অন্ন-আমিষ। ছাগল, গো ও মাহিষের দুগ্ধ ব্যতীত অন্য দুগ্ধই আমিষ। ব্রাহ্মণের বিক্রিত সর্বপ্রকার লবণ ও ভূমিজাত লবণ, তাম্রপাত্রস্থিত গব্য, চর্মস্থিত জল ও নিজের জন্য পাচিত অন্ন-আমিষ মধ্যে গণিত।
*>>ব্রহ্মচর্য অর্থাৎ অমৈথুন, অধঃশয্যা, পত্রাবলিতে ভোজন, বিকেলে ভোজন, পুরুষোত্তম মাসে প্রশস্ত রজস্বলা, ম্লেচ্ছ পতিত, ব্রাত্য-ব্যক্তি, দ্বিজদ্বেষী, বেদবাহ্য-এই সকলের সহিত আলাপ করবে না। এসকল ব্যক্তির দৃষ্টি এবং কাকদৃষ্ট অন্ন, সূতকান্ন, দ্বিপাচিত অন্ন ও দগ্ধান্ন খাবে না।
* >>পেঁয়াজ, রসুন, মুস্তা, ছত্রাক, গাজর, নালিতা, কেমুক-নামক মূলক, শাজনা এসমস্ত বর্জন করবে।
কার্তিক এবং মাঘেও এসকল নিয়মে ব্রত করবে। প্রাতঃকালে উঠে পৌর্বাহ্নিকী-ক্রিয়া | সমাপনপূর্বক শ্রীকৃষ্ণকে ভক্তিপূর্বক হৃদয়ে স্মরণ করে পূর্বোক্ত নিয়মগুলো গ্রহণ করবে।
ব্রত তিন প্রকার অর্থাৎ
১। উপবাস,
২। নক্তহবিষ্যান্ন গ্রহণ ও
৩। একভোজন
একভোজন ব্রতীর পক্ষে সেটি কর্তব্য বলে বোধ হয়, তা নিশ্চয় করে এই আচরণ করবে । এই মাসে ব্রত শতক্রতু অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। কেননা, ক্রতু (এক প্রকারের যজ্ঞ) করে স্বর্গ লাভ হয়, কিন্তু যিনি পুরুষোত্তম ব্রত করেন, তাঁর দেহে সকল তীর্থক্ষেত্র ও দেবতাগণ থাকেন। এই ব্রত উদযাপন সম্বন্ধে বাল্মীকি বললেন, “হে মহারাজ! কৃষ্ণ পক্ষে চতুর্দশী নবমী অথবা অষ্টমী তিথিতে পুরুষোত্তম মাসে এই ব্রতের উদযাপন করতে হয়। বিশুদ্ধভক্ত ব্রাহ্মণকে নিমন্ত্রণ করে | সমাহিত মনে উদযাপন ক্রিয়া করবে। পঞ্চধ্যানের দ্বারা অতি সুন্দর সর্বতোভদ্র রচনা করবে। চারিটি কলস মণ্ডলোপরি স্থাপনপূর্বক চতুর্ব্যহ প্রীতি কামনায় শ্রীফলান্বিত করবে। সদ্বস্ত্র বেষ্টিত পান দ্বারা চতুর্ব্যহ স্থাপন করবে।
শ্রীরাধামাধবকে কলসের সঙ্গে স্থাপন করিবে। বেদ বেদাঙ্গপারগ বৈষ্ণবাচার্যকে বরণ করবে। চতুর্ব্যহ জপ করে চতুর্দিকে চারটি দীপ প্রজ্বলিত করবে। ক্রমে শ্রদ্ধাভক্তির সঙ্গে সপত্নীক নারিকেলাদি অর্ঘ্য দান করবে। পরে ভক্ত ব্রাহ্মণে পূর্ণপাত্র দান করে আচার্যকে দক্ষিনা দিবে। তারপর দান করবে। এ সময়ে উপযুক্ত বৈষ্ণব ব্রাহ্মণকে ভাগবত দান করবার বিধি রয়েছে।
ব্রাহ্মণকে সংপুটিত কাংস্যপাত্র দান করবে। পরে ব্রাহ্মণদিগকে ঘৃত-পায়েস ভোজন করাবে। সকলকে অনুবিভাগ করে দিয়ে স্বজনের সঙ্গে ভোজন করবে। উদ্যাপন করে ব্রত নিয়ম পরিত্যাগ করবে। এই শাস্ত্রে শ্রীপুরুষোত্তম ব্রত সম্বন্ধে পূর্বে যেসমস্ত বিধি-নিয়ম লিখিত হয়েছে, সে সমস্ত সর্ব বর্ণধর্মপরায়ণ ধার্মিক লোকের পালনীয়। ভারতভূমিতে জন্মলাভ করে যে গৃহাসক্ত নরাধমগণ শ্রীপুরুষোত্তম ব্রতকথা শ্রবণ এবং ব্রত পালন করে না, সেই দুর্ভাগাগণ জন্ম মরণ এবং পুত্র, মিত্র, কলত্র ও নিজজনের বিয়োগজনিত দুঃখভাগী হয়।
হে দ্বিজবরগণ! এই পুরুষোত্তম মাসে বৃথা কাব্যালঙ্কারাদী অসৎশাস্ত্র আলোচনা করবে না, পরশয্যায় শয়ন এবং অনিত্য বিষয়ালাপ করবে না; পরান্নভোজন ও পরকার্য করবে না, বিত্তশাঠ্য পরিত্যাগপূর্বক ব্রাহ্মণদিগকে দান করবে। ধান থাকলে কৃপণতা করা রৌরব গমনের কারণ হয়। প্রতিদিন বৈষ্ণব ব্রাহ্মণদিগকে উত্তম ভোজন | দিবে। ব্রতী নিজে দিবসের অষ্টমভাগে ভোজন করবে। ইন্দ্রদ্যুম্ন, যৌবনাশ্ব ও ভগীরথ রাজগণ পুরুষোত্তমকে আরাধনা করে ভগবৎ-সামীপ্য লাভ করেছিলেন। সর্বপ্রকার যত্নের সহিত পুরুষোত্তমের সেবা করবে। এই পুরুষোত্তম সেবা সকল সাধন অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ এবং সর্বার্থফলদায়ক।
‘গোবর্ধন-ধরং বন্দে
গোপালং গোপরূপিণম্।
গোকূলোৎসবমীশনং
গোবিন্দং গোপিকাপ্রিয়ম্ ॥
প্রভৃতি মন্ত্রটি পূর্বে কৌণ্ডিন্যমুনি পুনঃপুনঃ জপ করেছিলেন।
শ্রীপুরুষোত্তম মাসে এই মন্ত্র ভক্তিপূর্বক জপ করে শ্রীপুরুষোত্তম দেবকে প্রাপ্ত হবে। নবঘন দ্বিভুজ মুরলীধর, পিতাম্বর শ্রীকৃষ্ণকে শ্রীরাধার সঙ্গে নিয়ত ধ্যান করতে পুরুষোত্তম মাস উদযাপিত করবে। যিনি ভক্তিপূর্বক এইরূপ করেন, তিনি সকল অভীষ্ট লাভ করেন।
ভগবান পুরুষোত্তমের উদ্দেশ্যে দীপদানঃ-
ভগবান পুরুষোত্তমের তুষ্টির জন্য দীপদান করা কর্তব্য। সামর্থ্য থাকলে ঘৃত-প্রদীপ, নতুবা তিল- তৈল-প্রদীপ দেয়া উচিত ।
যোগো জ্ঞানং তথা সাংখ্যং তন্ত্রাণি সকলান্যপি ।
পুরুষোত্তমদীপস্য কলাং নার্হন্তি ষোড়শীম্ ॥
আনুবাদ:
অষ্টাঙ্গযোগ, ব্রহ্মজ্ঞান ও সাংখ্যজ্ঞান এবং সমস্ত তান্ত্রিক ক্রিয়া পুরুষোত্তম মাসে দীপদানের ষোড়শী কলারও তুল্য হয় না।
পুরুষোত্তম ব্রতের বিশেষ সংখ্যা: ৩৩
এ মাসে ৩৩ সংখ্যাটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তাই রাধাকৃষ্ণের - উদ্দেশে ৩৩ বার দণ্ডবৎ প্রণাম, ৩৩ সংখ্যক প্রদীপ দান, ৩৩ সংখ্যক ফল ও পুষ্প প্রদান, ৩৩ টি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা বা অন্যান্য গ্রন্থ বিতরণ প্রভৃতি যেকোনো সেবায় ৩৩ সংখ্যার ব্যবহার। (পুরাণে বর্ণিত আছে, এ মাসে কৌশিক মুনি ও তাঁর পুত্র মৈত্রেয় মুনি ব্রাহ্মণ গণকে ৩৩ সংখ্যক আপূপ দান করেছিলেন। আপূপ-আতপ চাল, শর্করা ও ঘৃত দ্বারা তৈরি পিষ্টক বিশেষ)
হরি কথা শ্রবণঃ
পুরুষোত্তম-মাসে ভক্তিপূর্বক শ্রীমদ্ভাগবত গ্রন্থ শ্রবণ করবে। ভাগবত শ্রবণের পুণ্য বিধাতাও বলতে পারে না। ভক্তগণ শ্রী শালগ্রাম-শিলার অর্জন করবেন। একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তির উচিত, কোন শুদ্ধভক্তের মুখনিঃসৃত কৃষ্ণ কথা শ্রবণে নিজেকে নিয়োজিত করে, সর্বদা শ্রীকৃষ্ণের চিন্তা করা ও তার লীলাবিলাস সম্বন্ধে অন্য ভক্তদের নিকট আলোচনা করা। হৃদয়ে সর্বদা কৃষ্ণচিন্তা করার মাধ্যমে তৃপ্ত হওয়া উচিত।
হবিষ্যান্ন গ্রহণ পদ্ধতিঃ
আপনারা যারা পুরুষোত্তম ব্রত পালন করবেন তারা হবিষ্যান্ন ভোজন করবেন। হবিষ্যান্ন হল- গম, আতপ চাল, - মুগডাল, যব, তিল, মটর, কাঙ্গলি তণ্ডুল, উড়ী তণ্ডুল, বেতোশাক, হেলেঞ্চা শাক, আদা, কালশাক, মূলক, কন্দমূল, কাঁকুড়, কলা, সন্ধব ও সমুদ্র-লবণ, দধি, ঘৃত, অনুদ্ধৃত - দুগ্ধসার, কাঁঠাল, আম, হরিতকী, পিপ্পলী, জিরা, শুঁঠ, তেঁতুল, ক্রমুক, আতা, আমলকী-ফল, ইক্ষুজাত চিনি, মিশ্রি অতৈলপক্ক ব্যঞ্জনাদি-দ্রব্য-এই সমস্ত হরিষ্যান্ন। উপবাস ও হবিষ্যান্নে একই প্রকার ফল।