লীলাপুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাথে মা যশোদার দামবন্ধন লীলা- দামবন্ধন লীলা Mata Yashoda Dambandhana Leela with Lord Krishna

লীলাপুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাথে মা যশোদার দামবন্ধন লীলা- দামবন্ধন লীলা Mata Yashoda Dambandhana Leela with Lord Krishna

আমাদের প্রকৃত আলয় গোলকবৃন্দাবন যেখানে লীলাপুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অবস্থান করেন। আমরা যেহেতু আমাদের প্রকৃত আলয় ছেড়ে কারাগার রুপ এই জড়জগতে কষ্ট পাচ্ছি তাই লীলাপুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদের মত সাধারন জীবদের উদ্ধারের জন্য তিনি নিজেই এই জড়জগতে এসে আমরা যেন তাকে স্মরণ করতে পারি সেই জন্য তিনি ভৌমলীলায় অনেক আশ্চর্য ও চমকপ্রদ লীলা সম্পাদন করে গেছেন।  সেই লীলা গুলো স্মরন করে আমরা অতি সহজেই কৃষ্ণভাবনায় যুক্ত হয়ে ভগবানের কাছে ফিরে যেতে পারি।

 

লীলাপুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অনন্ত লীলার মধ্যে শৈশব লীলা অত্যন্ত মধুর। কিন্ত আজকে আমরা আলোচনা করব - ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাথে মা যশোদার দামবন্ধন লীলা

 

 

দামবন্ধন লীলার সূচনা

 

শ্রীল সনাতন গোস্বামীর মতে দামবন্ধন লীলাটি সংঘটিত হয়েছিল দীপাবলি উৎসবের দিনে। তখন কৃষ্ণের বয়স ছিল ন্যূনাধিক তিন বছর চার মাস। শ্রীকৃষ্ণ তখন গোকুল মহাবনে ছিলেন। শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তীপাদের মতে শ্রীকৃষ্ণ গোকুলে ছিলেন তিন বছর চার মাস। তারপর নন্দবাবা বৃন্দাবনে যমুনার পশ্চিম তীরে ছটিকরাতে চলে যান। সেখানে আরো তিন বছর চার মাস থাকার পর কাম্যবন এবং পরিশেষে নন্দগ্রামে অবস্থান করেন ।

 

একদিন মাতা যশোদা চিন্তা করছিলেন, কৃষ্ণ কেন অন্যান্য গোপীদের দধি, নবনীত ইত্যাদি চুরি করছে। নিশ্চয়ই তাঁর ঘরের তৈরি মাখন সুস্বাদু লাগছে না। হয়তো দাসীরা ভালোভাবে দধি মন্থন করছে না। এজন্য কৃষ্ণের মধ্যে ভয়ংকর চৌর্যবৃত্তি দেখা দিয়েছে। আমি যদি সুস্বাদু ননী তৈরী করি, তাহলে গোপাল আর অন্যের বাড়িতে ননী চুরি করতে যাবে না। এখানে যশোদা নামের অর্থটি খুবই প্রাসঙ্গিক। যশোদা- যিনি যশ দান করেন। মা যশোদাই কৃষ্ণকে ভক্তবশ্যতার যশ প্রদান করেছেন। তাই মহীয়সী যশোদা মাতা ঠিক করলেন, তিনি আজ নিজেই দধি মন্থন করবেন।

 

পিতা নন্দ মহারাজের নবলক্ষ গাভী ছিল। তার মধ্যে সাত-আটটি গাভী ছিল দুষ্প্রাপ্য পদ্মন্ধিনী গাড়ী। তাদের বিশেষ প্রকারের খাওয়ানো হতো। যশোদা মাতা ভাবলেন, এই গাভীদের দুধ থেকে অত্যন্ত উন্নতমানের সুস্বাদু মাখন বানানো যাবে।

 

কৃষ্ণ তখনও ঘুম থেকে ওঠেননি। তাঁর জেগে ওঠার আগেই দধিমন্থন করতে হবে। তাই মা যশোদা গৃহপরিচারিকাদের অন্যান্য কর্মে নিযুক্ত করে ব্রাহ্মমুহূর্তে দধি মন্থন করতে বসলেন। তিনি আপন মনে দধি মন্থন করার সময় ইতোমধ্যে সংঘটিত বিভিন্ন কৃষ্ণলীলা মৃদুস্বরে গাইতে লাগলেন।

 

শ্রীল প্রভুপাদ বলেছেন, যারা চব্বিশ ঘণ্টা কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত থাকতে চান, তাদের পক্ষে এই অভ্যাসটি আয়ও করা অবশ্যই কর্তব্য। কায়, মন ও বাক্য দ্বারাই সেবা করতে হয়। 

 

শ্রীমন্মহাপ্রভুও তাই বলেছেন- 

"কি শয়নে, কি ভোজনে কিবা জাগরণে।

 অহর্নিশি চিন্ত কৃষ্ণ, বলহ বদনে ” (শ্রীচৈতন্যভাগবত মধ্য- ২৮/২৮) 

আমরা সকল কাজ করার সময় মনে মনে- হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে। জপ করতে পারি।

 

শ্রীল শুকদেব গোস্বামী যশোদা মাতার রূপ ও গুণ বর্ণনা করেছেন। মাতা যশোমতি তখন হলুদ রঙের রেশমী কাপড় পরিধান করেছিলেন। এটি অতি পবিত্র কাপড়। দধিমহন কার্যে যেন কোনো অপবিত্র প্রভাব না পড়ে সে জন্যই এ আয়োজন। খুব ভোরেই মা এই কাজটি শুরু করেছিলেন, যেন কৃষ্ণের নিদ্রাভঙ্গের আগেই মাখন তোলা যায়। তবুও দধি মন্থনজনিত পরিশ্রমের কারণে তিনি ঘর্মাক্ত ছিলেন। তাঁর সর্বাঙ্গ কম্পিত হচ্ছিল। মাথার ফুলের মালাটি ইতঙ্কত বিক্ষিপ্ত হয়ে খসে পড়ছিল।

 

এই দৃশ্য সম্পর্কে আচার্যগণ বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন। কখন ও কুলে যেন নৃতাচ্ছলে মাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। "যে হাত ভগবানের সেবায় ব্যস্ত, আমরা সেই হাতে থেকে ধন্য”- একথা বোঝাতে হাতের কল্পনায় জানান শব্দ করছে। কানের কুফলগুলো যেন নেচে নেচে সূচিত করছে যে, মায়ের মুখে ভগবানের লীলাগান শুনে কান তার উৎপত্তির সার্থকতা লাভ করেছে। আর মাকো কবরীস্থিত মালতি পুষ্প খসে পড়ার মাধ্যমে বোঝাচ্ছে, হায়! হায়! বাহুল্য প্রেমের মূর্তিমতী মাতা যশোদার মাকে থাকার উচ্চতা কি আমাদের সাজে, তাঁর চরণ পেলেই ধন্য হব আমরা। "চিনুয় জগতে সবকিছুই স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। তাই সবকিছুর পৃথক পৃথক অভিব্যক্তি রয়েছে।

 

এদিকে মাত্রার ছন্দকের সেই অনুরূপে বহির্গত হচ্ছে। কেননা একবা সুস্বাদু নবনীত দেখে, কৃষ্ণের জন্য আপনা থেকেই মুগ্ধ নিঃসরিত হচ্ছে। আবার, করনের কনকন শব্দ আর দধি মন্থনের ঘরঘর শব্দ করতাল ও মৃদঙ্গ যেন বাদ্যরূপে মায়ের মুখের কৃষ্ণলীল সহায়তা করছে। একারণেই আমরাও ভগবানের বিভিন্ন সেবা করে আনন্দপাত করি। কেননা, ইন্দ্রিয়ের দ্বারা ইন্দ্রিয়াধিপতির সেবা করলেই ইন্দ্রিয়ের প্রকৃত তৃপ্তি লাভ করা যায়।

 

কৃষ্ণের নিদ্রাভঙ্গ ও দুগ্ধপান

 

এদিকে কৃষ্ণ ঘরের ভেতরে ঘুমিয়েছিলেন। সারারাত ঘুমিয়ে কৃষ্ণ স্বাভাবিকভাবেই খুব ক্ষুধার্ত থাকেন। তাই প্রতিদিন তাঁর ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে মা তাকে দুধপান করান। তাই আজও কৃষ্ণ ঘুম থেকে ওঠামাত্রই ক্ষুধার্ত হয়ে মাকে খোঁজ করছিলেন। তখন মায়ের কন্ঠে মৃদুত্তরে গান শ্রবণ করে ভাবলেন, মা আমাকে রেখেই বিছানা থেকে উঠে পড়েছে। আমার জন্য কি তার কোনো শ্চিন্তা নেই?” তাই, তিনি তাঁর দুই পহত্ত দ্বারা নেত্রযুগল মার্জনা করতে করতে সেই দখি মন্থন স্থানে এলেন।

 

মা যশোমতির কী প্রগাঢ় সেবানিষ্ঠা। ব্রহ্মা, শিব ও মহান যোগীরা বহুকাল ধ্যান করেও সহজে যাকে পান না, সেই কৃষ্ণ এসে মায়ের সম্মুখে দাড়িয়ে আছেন, অথচ তার কোনো খেয়ালই নেই। কৃষ্ণ ভাবলেন, আমার কিছু করা দরকার। তাই সরাসরি মন মত চেপে ধরলেন। কেননা এই মানদণ্ডই মাকে ব্যস্ত রেখেছে। আর কৃষ্ণ এখন সাক্ষাৎ দণ্ডায়মান। তাই মন্থনকার্য থামানোর মাধ্যমে কৃষ্ণ যেন যশোদা মায়ের সাধনার পূর্ণতার ইঙ্গিত দিচ্ছেন। যা যশোমতি কৃষ্ণকে বললেন- "একটু সবুর কর বাছা: অল্প একটু মাখন তুলে নিই।"

 

 "না, আমি এখুনি - এই বলে কৃষ্ণ জোর করে মায়ের কোমরে জাপটে ধরে, জানুর উপর পা দিয়ে কোলে উঠে পড়লেন থেকে স্বতঃসিরিত দুগ্ধধারা আম্মাননে মনোযোগ দিলেন। যা তখন কৃষ্ণের নয়নাভিরাম সুমধুর মুখপানে তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু সামনেই বৃহৎ চুল্লীর উপরে পদ্মিনী গাভীর দুধ গরম করা হচ্ছিল। এ গোদুগ্ধ মায়ের জনদুরে কৃষ্ণসেবা প্রাপ্তির সার্থকতা দেখে ভাবতে লাগল, প্রেমমযী মা যশোদার দুগ্ধতো কখনো ফুরাবে না, আর তো মিটবে না। তবে আমার কী হবে? যুগ যুগ ধরে সেই অধর স্পর্শ লাভের তপস্যা করছি, পেট ভরে গেলে তো কৃষ্ণ আমার দিকে ফিরেও তাকাবে না। আমি যদি কৃষ্ণের সেবায় ব্যবহৃত না হই, তবে আমার বেঁচে থেকে কী লাভ। বরং তাঁর সামনেই অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিয়ে আত্মবিসর্জন করি।” এই বলে অগ্নিতাপে স্ফীতা দুগ্ধ পাত্রের গা বেয়ে উপচে পড়তে লাগলো। মা হঠাৎ তা খেয়াল করলেন। তৎক্ষনাৎ দুধ নামানোর জন্য অতৃপ্ত কৃষ্ণকে কোল থেকে নামিয়ে মেঝেতে রেখে দৌড়ে চুলার দিকে যেতে লাগলেন।

 

এখন প্রশ্ন হতে পারে, মা যশোদার দেহ কী রকম? মনে হয়, কৃষ্ণের চেয়ে দুধের প্রতিই তাঁর মমতা অধিক। নতুবা তিনি কেন অতৃপ্ত কৃষ্ণকে ফেলে চলে গেলেন? এর উত্তর হচ্ছে- প্রেমী ভক্তের কাছে ভগবান অপেক্ষা ভগবানের সেবাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। মা যশোদার ভাব- আমার স্তনদুগ্ধ তো কৃষ্ণ পরেও খেতে পারবে, কিন্তু এই পদ্মিনী গাভীর উপাদেয় ও সুস্বাদু বিশেষ দুগ্ধ নষ্ট হয়ে গেলে কৃষ্ণ তা থেকে বঞ্চিত হবে। তাছাড়া, একটু পরেই কৃষ্ণ এসে যদি বলে- “আমাকে ননী-মাখন, ছানা দাও”। তখন তা না পেলে কৃষ্ণ হয়ত আবার কারো ঘরে ননীচুরি করতে যাবে। এই ভয়ে দুগ্ধ রক্ষার প্রতি মায়ের এত মনোযোগ।

 

এদিকে দুখ ভাবল- “হায়। আমার মতো পাপিষ্ঠ আর কোথাও নেই। আমার জন্য আজ যশোদা মাতা ও কৃষ্ণের প্রেম আদান-প্রদান ব্যাহত হলো।” তাই সেও

 

এভাবে তাকে ফেলে চলে যাওয়ার ফলে মায়ের ওপর কৃষ্ণের ভীষণ রাগ হলো। এখানে লক্ষণীয় বিষয়, যদিও ভগবান 'আত্মারাম' ও 'আন্তকাম', তবে তিনি কুরুদ্ধ হলেন কেন? হয়ত মা যশোদার প্রীতিবন্ধনে তিনি যে কতটুকু আবিষ্ট তা একটু পরেই প্রমাণ করবেন সেজন্য। ক্রোধবশত, তাঁর অরুণবর্ণ ঠোঁটে সাদা দুধের দাঁত দিয়ে তিনি কামড় দিচ্ছিলেন আর ভাবছিলেন- "মা তুমি এত কৃপণ, আজ দুধ-ই তোমার কাছে বড় হয়ে দাঁড়ালো। আমি কত ক্ষুধার্ত, আমার জন্য তোমার কোনো চিন্তাই নেই। সামান্য দুধের জন্য এমন করতে পারলে। ঠিক আছে, দেখাচ্ছি মজা।” এই বলে অশ্রু মোচন করতে করতে নিকটস্থ পেষণী (মাশলা বাটায় ব্যবহৃত- নোড়া) দিয়ে দধিভাণ্ডটি ভেঙে ফেললেন। দধিভাণ্ডটিও আবার তলদেশ দিয়ে ভাঙলেন, যেন খুব বেশি শব্দ না হয়। এরপর সদ্যোজাত নবনীত খেতে খেতে পাশের ঘরে চলে যেতে লাগলেন। আর ভাবছেন- “যেহেতু আমাকে তোমার কোল থেকে নামিয়ে দিয়েছ, তাই আমি কোনো খল ব্যক্তির কাছে চলে যাব।” তখন কৃষ্ণ রেগে গিয়ে সেখানে উল্টোভাবে রাখা উদ্‌খলের উপর বসলেন। মায়ের কোলে বসতে না পেরে উদুখলে বসেছেন। এরপর প্রচণ্ড ক্রোধে শিকায় রাখা সমস্ত মাখন বানরদের বিতরণ করতে লাগলেন। আবার, মা আসে কি না ভেবে, চুরি করার দায়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে শঙ্কিত নেত্রে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলেন। বৈষ্ণব আচার্যগণের ভাব হয়তো রাম অবতারের কথা স্মরণ হয়েছে, তখন কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই বানরদের কাজে লাগানো হয়েছে। তাই, কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এদের কিছু দেওয়া উচিত। আবার, এ-ও হতে পারে যে, ক্রোধবশত দধিভাণ্ড ভাঙার অপরাধের প্রায়শ্চিত্তই এ দানব্রত।

 

মা যশোদার কৃষ্ণ অন্বেষণ

 

মা যশোদা চুলা থেকে গরম দুধ নামিয়ে রেখে দধি মন্থন স্থানে ফিরে এসে দেখলেন দধিভাও ভগ্ন হয়েছে এবং সেখানে কৃষ্ণকে না দেখতে পেয়ে তিনি স্বাভাবিকভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন তা কৃষ্ণেরই কার্য। এরপর মেঝেতে পড়ে থাকা দধির মধ্যে ছোট ছোট পায়ের ছাপ দেখতে পেয়ে তিনি হাসলেন। একটি ছোট ছড়ি নিয়ে পেছন দিক থেকে লুকিয়ে, আস্তে আস্তে কৃষ্ণের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন।

 

কৃষ্ণের পলায়ন

 

মা ছড়ি হাতে দাঁড়িয়ে আছে দেখে কৃষ্ণ অত্যন্ত ভীত হলেন এবং তৎক্ষণাৎ উদ্‌খল থেকে লাফিয়ে নেমে দ্রুত বেগে ছুটতে লাগলেন। যোগীরা মনের গতিতে যাঁর দিকে ধাবিত হয়েও তাঁকে প্রাপ্ত হয় না, তাঁকে ধরার জন্য মা যশোদা ছড়ি হাতে পশ্চাদ্ধাবন করছেন। কৃষ্ণ জানতেন যে, আজ মা যদি তাঁকে ধরতে পারে, তবে আর রক্ষা নেই। কেননা আজ অনেকগুলো দুষ্কর্ম করা হয়েছে। বৈষ্ণব আচার্যগণ বলেন, এই লীলায় শ্রীকৃষ্ণ এতটাই মগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন যে, তিনি ভয়ের অভিনয়ের পরিবর্তে মা যশোদার বাৎসল্য প্রেমের বশীভূত হয়ে সত্যিই ভয় পেয়েছিলেন। তাই, সর্বগ্রাসী কাল যাঁর ভয়ে ভীত, সেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আজ ভীত শঙ্কিত হয়ে পলায়ন করছেন।

 

মা যশোদার পক্ষেও দ্রুত দৌড়ানো সম্ভব ছিল না। তাঁর শরীর ও বেশভূষা দুই-ই যেন তাঁর সঙ্গে বিরোধিতা করছিল- "কেন তুমি আজ কানাইকে তাড়া করছ?" প্রথমে ঘরের ভেতরে দৌড়াদৌড়ি হচ্ছিল। পরে কৃষ্ণ গোকুলের রাস্তার চলে এলেন। এদিকে ব্রজবাসীরা এই দৌড় প্রতিযোগিতা দেখছিলেন।

 

যশোদার ভর্ৎসনা

 

দুরন্ত কৃষ্ণ এদিক-সেদিক দৌড়াতে লাগলেন। কিন্তু নিতম্বভাবে যশোদাদেবীর গতি মন্থর হলো। ঘর্মাক্ত কলেবর অবস্থায় মাথার কবরী খুলে গেল। কৃষ্ণ পেছন দিকে তাকিয়ে দেখতে চাইলেন মা কত দূরে। কিন্তু যশোদাদেবী খপ করে তাঁর ডান হাত ধরে ফেললেন।

 

বা হাতে কৃষ্ণ তাঁর নয়নপদ্মযুগলের অশ্রুমোচন করছিলেন। এতে চোখের কাজল সারা মুখে ছড়িয়ে যায়। তিনি বারবার ভীতশঙ্কিত নেত্রে মায়ের মুখের দিকে তাকাচ্ছিলেন। মা তখন লাঠি দ্বারা ভয় দেখিয়ে বলতে লাগলেন, "রে দুষ্ট, বানরবন্ধু, দধিভাও ভগ্নকারী। এখন ননীমাখন কোথায় পাবে? আজ এমনভাবে বেঁধে রাখব যেন বালকদের সাথে খেলতে না পার। এখন কেন ভয় পাচ্ছ?”

 

দামবন্ধন লীলা

 

পুত্রের মঙ্গল-আকাঙ্ক্ষীরূপে তিনি জানতেন যে, এইটুকু শিশুকে এতটা ভয় দেখানো ঠিক হবে না। অথচ তাঁকে একটু দণ্ড না দিলেও নয়। তাই, হাতের ছড়িটা ফেলে দিয়ে তাঁকে বেঁধে রাখতে মনস্থ করলেন। কেননা, ভয় পেয়ে আবার কোথায় পালিয়ে যায়, তার ঠিক নেই। তাই, যার ভেতর-বাহির নেই, আদি-অন্ত নেই। যিনি জগতের পূর্বেও ছিলেন পরেও থাকবেন; যিনি জগতের ভেতরেও আছেন, বাইরেও আছেন, আবার জগৎরূপেও বর্তমান। শুধু তা-ই নয়, যিনি ইন্দ্রিয়ের অতীত, অব্যক্ত কিন্তু মনুষ্যরূপে লীলা করায় মা তাঁকে স্বীয়পুত্র মনে করে উদ্‌খলের সাথে বেঁধে রাখলেন। উদূখলের সাথে বাঁধার কারণ, যে ব্যক্তি চুরিতে সহায়তা করে সেও চোর। যেহেতু উদ্খল কৃষ্ণের চুরিতে সহায়তা করেছে, তাই উদ্‌খল ও কৃষ্ণ- এ দুই চোরকে একসাথে । মা যশোদা যখন অপরাধী বালকটিকে বাঁধার চেষ্টা করছিলেন, তখন দু-আঙুল দড়ি কম পড়ল। কেননা, ভগবানের কৃপাদৃষ্টি যার ওপর পড়ে তিনি মুক্ত হয়ে যান। মুক্ত জিনিসে আবার বন্ধন হবে কী করে? অথবা, গো-বন্ধনকারী (ইন্দ্রিয়সমূহ বন্ধনকারী) দড়ি আবার গো-পতিকে (ইন্দ্রিয়াধীশকে) বন্ধন করবে কী করে?

 

তবে কেন মাত্র দু-আঙুল কম পড়ল, এ বিষয়ে বলা যায়- ভক্তের পূর্ণ প্রচেষ্টা এবং ভগবানের করুণার অপূর্ণতাই এর কারণ। তাই, তিনি তখন সেই দড়িটির সাথে আরেকটি দড়ি যুক্ত করলেন। কিন্তু তবুও দু-আঙুল কম পড়ল। এভাবে, যত দড়ি যোগ করা হয়, তা-ই দু'আঙুল কম পড়ে । এভাবে নিজগৃহের সমস্ত দড়ি ফুরিয়ে গেলে, অন্যান্য ব্রজবাসীদের গৃহ থেকে দড়ি আনার পরেও একই অবস্থা। এতে গোপীরা হাসতে শুরু করল, আর যশোদাও হাসতে হাসতে বিস্ময়াপন্ন হলেন। কেননা, যাঁর কোমর মাত্র এক মুষ্টি, কিন্তু একশ হাত দড়িতেও তা বাঁধা পড়ছে না। তখন গোপীরা বলতে লাগল, “দেখ যশোদা, শুর কোমরে ছোট্ট সুতোয় বাঁধা কিঙ্কিনি কেমন রুনুঝুনু বাজছে। আর এত দড়ি দিয়েও তুমি তাঁকে বাঁধতে পারছ না। হয়তো, এর কপালে আজ বন্ধন নেই।" যশোদা বললেন, “আজ যদি সন্ধ্যা হয়ে যায়, গ্রামের সমস্ত দড়িও প্রয়োজন হয়, তবুও একে ছাড়ব না।” ভগবান যখন ভক্তের চেষ্টা দেখেন, তখন তিনি কৃপাপূর্বক বন্ধন স্বীকার করেন। তাই, যশোদার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা দেখে, ভগবান তাঁর প্রতি করুণাপরায়ণ হলেন।

 

যিনি স্বীয় মায়ারজ্জুতে নিখিল জগৎ বন্ধন করে রেখেছেন, তিনি আজ মায়ের রজ্জুবন্ধনে আবদ্ধ হলেন। শিব, ব্রহ্মা, ইন্দ্র প্রমুখ মহান দেবতাগণসহ এই নিখিল বিশ্ব যাঁর বশীভূত, সেই স্বতন্ত্র ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এভাবে তাঁর ভক্তবশ্যতা দেখিয়েছেন । মা যশোদা মুক্তিদাতা শ্রীকৃষ্ণের কাছে যে অনুগ্রহ লাভ করেছেন, তা ব্রহ্মা, মহেশ্বর এমনকি ভগবানের বক্ষ-বিলাসিনী লক্ষ্মীদেবীও প্রাপ্ত হননি। যশোদানন্দন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বতঃস্ফূর্ত প্রেমময়ী সেবায় যুক্ত ভক্তদের পক্ষে যেমন সুলভ, মনোধর্মী জ্ঞানী, আত্মোপলব্ধিকামী তাপস বা দেহাত্মবুদ্ধি পরায়ণ ব্যক্তির কাছে তেমন সুলভ নন ।

 

বাৎসল্যের নিকট ঐশ্বর্যের পরাজয়

 

    কৃষ্ণকে বাঁধা অবস্থায় দেখতে পেয়ে বলরাম অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হয়েছিলেন। তিনি হুঙ্কার করতে লাগলেন, “কে বেঁধেছে? কার এত বড় সাহস?” তখন সামনে বালকদের মধ্যে কেউ মাতা যশোদার নাম বলে দিল। তখন যশোদা মাতাও এদিকে এলেন। বলরামকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে? চেঁচামেচি করছ কেন?” বলরাম বললেন, “তুমি জানো কৃষ্ণ কে? এই কৃষ্ণই নারায়ণ, ক্ষীরোদকশায়ী বিষ্ণু, বামন, মৎস্য, কূর্ম; এই কৃষ্ণই নৃসিংহরূপে হিরণ্যকশিপুর বক্ষ বিদারণ করেছিল, .।” যশোদা বললেন, “আর তুমি কে?” বলরাম জানালেন, “আমি সংকর্ষণ, আমি শেষনাগ, আমার মাথায় এই সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড সর্বপাকৃতির ন্যায় বিরাজ করে। আমি মুহূর্তেই এই বিশ্ব ধ্বংস করে দিতে পারি।” মা যশোদার বাৎসল্য প্রেম এতই প্রবল যে, বলরামের এসকল বাক্যের প্রতি কোনো ভ্রূক্ষেপ না করেই বলতে লাগলেন- “আরে আরে...! সব অবতারই আমার ঘরে ঢুকে বসে আছে। কেন? আর কোনো ব্রজবাসীর ঘরে কি জায়গা ছিল না? আমার ছড়িটা কোথায়? এখুনি নৃসিংহ আর সংকর্ষণের ভূত পিটিয়ে ছাড়াব।" বলরাম তখন ভয় পেয়ে দৌড়ে পালালেন। বাৎসল্য প্রেমের কাছে ভগবানের ঐশ্বর্য আজ পরাভূত হলো।

 

উপরের আলোচনা থেকে আমরা জানতে পারি যে, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যিনি এই সমগ্র বিশ্বচরাচরের মালিক । যার ইশারাতেই সমস্ত কিছু সাধিত হয়। নিজস্ব প্রচেষ্টাতে কখনো তাকে পাওয়া যাবে না।  

 

কিন্তু এখানে কিছু প্রশ্ন হতে পারে–

শ্রীকৃষ্ণ এখানে অনেকগুলো আশ্চর্যমণ্ডিত ও অপ্রকাশিত গুণাবলি প্রদর্শন করেছেন- যিনি আত্মারাম, যাঁর কিছুই দরকার নেই, তিনি মাতৃদুগ্ধের জন্য লালায়িত হলেন।

- যিনি সর্বদাই সন্তুষ্ট, তিনি পর্যাপ্ত দুগ্ধ পান করেও অতৃপ্ত ও ক্রোধান্বিত।

- যিনি সবচেয়ে শুদ্ধ, ত্রিগুণাতীত, তিনি রজোগুণাত্মক ক্রোধান্বিত হলেন। যাঁর ভয়ে ভয়ংকর কাল, যমরাজ, এমনকি মূর্তিমান ভয়ও ভীত হয়, তিনি মাতার শাসনের জন্য ভীত হলেন। ও মনের গতিতে ধাবমান হয়েও যোগীরা যাঁকে ধরতে পারেন না, মাতা যশোদার কাছে তিনি খুব সহজেই ধরা পড়লেন।

 

আপনাদের মতামত অবশ্বই কমেন্ট করে জানাবেন।