মলমাস কি? পুরুষোত্তম মাস কাকে বলে। পুরুষোত্তম মাস আগমনের কারণ- What is Malmas or Purushottam month?
আমরা জানি ৩৬৫ দিন সমান এক বছর এবং এক বছরে বারটি মাস হয়। কিন্তু একটি অতিরিক্ত মাস যাকে বলে মলমাস। স্মাতবাদী পণ্ডিতেরা এই অধিমাসকে ‘মলমাস’ বা ‘মলিনমাস' বলে ঘৃণা করে। কিন্তু গোলোকাধিপতি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং এই মাসকে সর্বশ্রেষ্ঠ মাস বলে স্থাপন করেছেন। কিন্ত কেন? এটাই আজকের আলেচনার বিষয়ঃ-
মলমাস কি?
চান্দ্রমাস ও সৌরমাস গণনায় মিল রাখার জন্য প্রতি ৩২ মাসে একটি মাস অতিরিক্ত হয়। সেই | মাসটির নাম ‘অধিমাস'। শাস্ত্রানুসারে একটি বৎসরকে দ্বাদশ মাসে ভাগ করে বারো মাসে সকল প্রকার সৎকর্ম ও পূজা-পার্বণের নির্ঘণ্ট করা হয়েছে। বর্ণাশ্রমগত সমস্ত কর্মই যখন বারোটি মাসে বিভক্ত হলো, তখন ‘ অধিমাস' কর্মহীন হয়ে গেল। কেননা, অধিমাসে কোনোরকম পুণ্যকর্মের বিধান শাস্ত্রে দেখা যায় না। যেহেতু এই মাসে কেনো প্রকার | কর্মকাণ্ডীয় ক্রিয়ানুষ্ঠান পালিত হয় না, তাই স্মাতবাদী পণ্ডিতেরা অধিমাসকে ‘মলমাস’ বা ‘মলিনমাস' বলে ঘৃণা করে।
কিন্তু পরমার্থ শাস্ত্র এই অধিমাসটিকে সর্বোপরি শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা করেছে। জীবনের কোন অংশেই বৃথা যাপন করা উচিত নয়। সর্বদা হরিভজন করাই জীবনের কর্তব্য। আবার যেহেতু এই মাসটি সকল প্রকার কর্মশূন্য, তাই সেটি হরিভজনের জন্য অধিক উপযোগী। গোলোকাধিপতি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং এই মাসকে কার্তিক, মাঘ ও বৈশাখ আদি মহাপুণ্য মাস অপেক্ষা | সর্বশ্রেষ্ঠ মাস বলে স্থাপন করেছেন।
অন্য সকল মাসের অধিপতি পুরুষোত্তম মাস-
এই পুরুষোত্তম মাসকে অন্য সকল মাসের থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ কারণ বৃহন্নারদীয় পুরাণে অধিমাসের মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। দ্বাদশ মাসের আধিপত্য দেখে, এই অধিমাস বৈকুণ্ঠাধিপতি শ্রীনারায়ণকে নিজ দুঃখ জ্ঞাপন করেছিলেন। তাই স্বয়ং নারায়ণও কোনো উপায়ান্তর না দেখে অধিমাসকে সঙ্গে করে গোলোকে শ্রীকৃষ্ণের কাছে গেলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অধিমাসের (মলমাসের) আর্তি শ্রবণ করে দয়ার্দ্র চিত্ত হলেন। শ্রীকৃষ্ণ বললেন, হে রমাপতি! আমি যেমন এই জগতে 'পুরুষোত্তম' নামে খ্যাত এই অধিমাসও তদ্রুপ ‘পুরুষোত্তম’ নামে বিখ্যাত হবে। আমাতে যেসকল গুণ আছে, তৎসমস্তই এই মাসে অর্পণ করলাম।
আমার সদৃশ হয়ে, এই অধিমাস অন্যসকল মাসের অধিপতি হলো। অন্য সকল মাস সকাম, এই মাসটি নিষ্কাম। যিনি সকাম বা নিষ্কামভাবে এ মাসে পূজা করেন, তিনি সকল কর্ম ভস্মসাৎ করে আমাকে প্রাপ্ত হন। অন্যান্য মাসে আমার ভক্তদের শুদ্ধভক্তি যাজনে সকাম কর্মের | বাসনায় শুদ্ধভক্তি বাধাগ্রস্ত হতে পারে। যেহেতু, এই সকল | মাসেই সকাম কর্ম রয়েছে। তাই আমি সকাম কর্মের ফল দান করি। কিন্তু পুরুষোত্তম মাসে যদি কোনো ভক্তের শুদ্ধভক্তি যাজনের ক্ষেত্রে সকাম কর্মের বাসনা তার চিত্তে উদিতও হয়, তবুও পুরুষোত্তম মাসে সকাম কর্মের বাসনা দ্বারা শুদ্ধভক্তি দোষদুষ্ট হয় না। কারণ এই মাসে কোনো সকাম কর্ম নেই।
সমস্ত মাসব্যাপী শুদ্ধভক্তি যাজনের মাধ্যেমে কেবল শুদ্ধভক্তিই লাভ হয়। যে মূঢ়মতি এই মাসে জপ-দানাদি বর্জিত ও সৎকর্ম-স্নানাদি রহিত থাকে ও দেব তীর্থ এবং দ্বিজগণের প্রতি হিংসাভাব পোষণ করে, সে স্বপ্নেও সুখ পায় না। এই মাসে যিনি আমাকে ভক্তিপূর্বক অর্চন করেন, তিনি ধন-পুত্রাদি | সুখভোগ করে অবশেষে গোলোকবাসী হন ।
পুরুষোত্তম মাসের আগমনের কারণ-
আমাদের দেশে প্রায় বিবিধ প্রকার বর্ষপঞ্জী (ক্যালেন্ডার) প্রচলিত। সেগুলো হলো সৌর, চান্দ্র, চান্দ্রসৌর, ঐতিহাসিক ঘটনাগত (বিক্রমাব্দ, শকাব্দ ইত্যাদি) রাশিগত প্রভৃতি। কৃষ্ণা প্রতিপদ থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত হলো চান্দ্রমাস। চন্দ্রমাস অনুযায়ী | সনাতন ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি হয়। এই ভাবে চান্দ্রবর্ষ হয় ৩৫৫ দিনে। কিন্তু সৌরবর্ষ হয় ৩৬৫ দিনে। তাই সৌর ও চন্দ্র সমন্বয়ের জন্য প্রতি তিন বৎসর পর পর যে একমাস (৩০ দিন) অতিরিক্ত হয় তাহাই মলমাস/অধিক মাস। এই মাসে সূর্যসংক্রান্তি থাকে না ।
জ্যোতিষ বচন অনুসারে সূর্য বছরের বারো মাসে ১২টি রাশিতে অবস্থান করে। কিন্তু “শাকুন্যাদি চতুষ্কং তু রবের্মলমুদাহৃতম | তদূর্দ্ধং ক্রামতে ভানোমাসঃ স্যাত্তু মলিল্লুচাঃ'।” অর্থাৎ শাকুনি চতুষ্পাদ নাগ ও ঝিংস্তগ্ন-এই চার প্রকার করণ হল সূর্যের অবশিষ্টাংশ। এই অবশিষ্টাংশই হলো মলমাস বা অধিমাস বা পুরুষোত্তম মাস। কোনো মাসে তিনটি প্রতিপদ তিথির সঞ্চার হইলে অথবা দুইটি অমাবস্যা হয় এবং রবিসংক্রান্তি ঘটে না, সেই মাসকে মলমাস বা অধিক মাস বলে। |
মলমাস বা অধিক মাসে স্মার্ত ব্রাহ্মণগণ কাম্যকর্ম, বিবাহ ইত্যাদি করেন না। তাদের দৃষ্টিতে মলমাস বা অধিক মাসে কর্মকান্ড অশুভ। কিন্তু ব্রজধামে এই মাসকে পুরুষোত্তম মাস বলে থাকে । বৈষ্ণবগণ এই মাসে অনেক বেশি শ্রীহরিনাম সংকীর্তন করেন অর্থাৎ হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।
প্রাচীন ঋষিগণ বলে গেছেন চন্দ্র যখন সৌরমণ্ডলে অবস্থান করে এবং সেই সময় সূর্যের অয়নপথে রাশি পরিবর্তন কাল হয় বা | সহজ কথায় এক রাশি ত্যাগ করলেও অন্য রাশিতে পৌঁছায় না তবে সেই সময় হলো মলমাস। অর্থাৎ বর্জনীয় মাস।
কিন্তু মেয়াদ অন্তে পুনরায় পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করতে হয়। পক্ষান্তরে এই মলমাসে সৎকর্ম করলে মোক্ষপ্রাপ্তি ঘটে। অর্থাৎ পুনর্জন্ম থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
তাই হিন্দু শাস্ত্রমতে মলমাস হলো গুরুত্বপূর্ণ সময়। তবে একে এত ভাল বলা হলেও আপামর মানুষের কাছে এটি অশুভ বলেই গণ্য । এই সময় পৃথিবীতে রোগ বিস্তারলাভ করে। মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। দেশে বিদেশে বিভিন্ন বিষয়ে তীব্র মতভেদ দেখা দেয়। যা পারস্পরিক বিবাদ ও সন্দেহের বাতাবরণ সৃষ্টি করে। এর ফলে বেড়ে যায় হিংসকর্ম ও উগ্রপন্থা। আর এর ফলশ্রুতি হলো লোকক্ষয়। চারদিকে একটা ধ্বংসাত্মক ইঙ্গিত থাকে বলেই শুভকর্ম সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। তাই বিবাহ উপনয়ন নতুন গৃহাদি নির্মাণ গৃহপ্রবেশ শুভকর্মারম্ভ ইত্যাদি এই সময় নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
তবে শাস্ত্রে বেশি করে ভগবত কর্ম করার নির্দশ দেয়া হয়েছে তাই আপনারা এই পুরুষোত্তম মাসে বেশি করে ভগবানের যে সকল কর্মাদি রয়েছে তা আপনারা বেশি করে পালন করবেন।