নবকলেবর কি? জগন্নাথের বিগ্রহ সমাধি। What is Nabakalebara
জয় জগন্নাথ। জগন্নাথ অনেক লীলা করেছেন তার ভক্তদের মনোবাসনা অনুযায়ী। কিন্তু পুরীতে যে নিয়মকানুন এর কোন পরিবর্তন হয়নি সত্য যুগে যে নিয়মকানুন ছিল বর্তমান অবধি সেই একই নিয়মে চলছে। জগন্নাথের বিভিন্ন নীলার মধ্যে নবকলেবর লীলা আজকের আলোচনার বিষয়-
নবকলেবর কি?
সাধারণ ভক্তের মনে নব কলেবর কেন হয় এবং এর বিশেষত্ব কি এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। যে বছর জোড়া আষাঢ় পড়ে সেই বছরটি শ্রী জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার নব কলেবর হয়। নব কলেবর অর্থাত্ প্রভু জগন্নাথ, বলভদ্র, দেবী সুভদ্রা ও সুদর্শনের নতুন বিগ্রহ প্রস্তুতির পরে ব্রহ্ম পরিবর্তন নবযৌবন দর্শন এবং রথ যাত্রা উত্সব।
বিগ্রহের প্রস্তুতির জন্য দারু অন্বেষণ যা কাকটপুরের মা মঙ্গলার স্বপ্নাদেশে বনযাগ যাত্রা নামে বলা হয়।
এই যাত্রা থেকে নব কলেবরের প্রস্তুতি পর্ব আরম্ভ। নব-কলেবর সম্বন্ধে কিছু তথ্য-
যে বছর জোড়া আষাঢ় পড়ে সেই বছরটি শ্রী জগন্নাথ, বলভদ্র ও দেবী সুভদ্রার নব কলেবর হয়। সাধারণত জোড়া আষাঢ় ৮, ১২ ,১৬ কিম্বা ১৯ বছর পর পড়ে। বিংশ শতাব্দীর নব কলেবর যাত্রা প্রথমে ১৯১২, ১৯৩১, ১৯৫০, ১৯৬৯, ১৯৭৭ এবং ১৯৯৬ সালে হয়েছিল। ২০১৫ সালে নব কলেবর যাত্রা ১৯ বছর বাদে পড়েছে।
বনযাগ যাত্রা শুরু
পুরীর গজপতি রাজা শ্রী দিব্য সিংহ দেব রাজগুরুকে পৈতে, বস্ত্র এবং সুপুরি প্রদান করে বনযাগ যাত্রার জন্য আদেশ দেন। এই পরম্পরাকে গজপতি "রাজার আজ্ঞা" বলে বলা হয়। সেই থেকে বনযাগ যাত্রার শুভারম্ভ হল।
নব কলেবর নিমিত্ত তিন ঠাকুরের জন্য যে বৃক্ষ চিহ্নিত করা হয় তার লক্ষণ গুলো নিম্ন লিখিত অনুসারে নির্বাচন করা হয়-
১. বৃক্ষটি নিম বৃক্ষ হওয়া প্রয়োজন।
২. বৃক্ষের অনতিদূরে ঊই ঢিপি, নদী, শ্মশান কিংবা পুকুর থাকা অনিবার্য। বৃক্ষের কাছে বেল গাছ, তুলসী গাছ থাকা প্রয়োজন।
৩. বৃক্ষে কোন পাখির বাসা থাকবে না, ঊই ঢিপির কাছে গোখরো সাপ গাছটিকে পাহারা দিতে দেখা যাবে।
৪. বৃক্ষের কোন অংশ কীট পতঙ্গ দ্বারা আক্রান্ত, কিংবা বজ্র পাতের চিহ্ন থাকবে না। পূর্বে কোন ডাল কাটা থাকবে না। কোন রকম খুঁত থাকা চলবে না।
৫. সেই বৃক্ষে শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম চিহ্ন থাকা প্রয়োজন।
৬. বৃক্ষটি ১২ ফুট লম্বা, সোজা এবং মোটা হওয়া প্রয়োজন যাতে অনায়াসে বিশ্বকর্মার দ্বারা বিগ্রহ নির্মাণ কর্ম সুসম্পন্ন হবে।
উপরোক্ত লক্ষণ গুলো অনিবার্য এবং তারপর অন্বেষণকারী দল ঠিক করে পবিত্র দারু নির্বাচন করেন। এরপর দারু নির্বাচন কার্য সুসম্পন্ন হয়।
ব্রহ্ম পরিবর্তন ও বিগ্রহসমাধি
জগন্নাথদেবের দইতাপতি সেবকরাই নব কলেবর ও ব্রহ্ম পরিবর্তনের দায়িত্ব পালন করেন। নবকলেবর ও ব্রহ্ম পরিবর্তন- পুরীর মন্দিরের দুটো পবিত্রতম কর্ম সুষ্ঠভাবে সম্পাদন করা হয়ে থাকে।
দইতাপতি সেবকরা এই কলিযুগেও দেবী মঙ্গলার স্বপ্নাদেশ পান। এভাবেই জানা যায় বিগ্রহ নির্মাণের উপযুক্ত নিমগাছ কোন কোন জায়গায় পাওয়া যাবে। আর নবকলেবরের সময় ব্রহ্ম পরিবর্তন সাধারণত রাতে হয়। অবশ্য তা তিথি, নক্ষত্র বিচার করেই করা হয়।
পুরীর মন্দিরের প্রাক্তন এক প্রশাসককে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল ব্রহ্ম বস্তুটি কি জিনিস। তিনি বলেন, "ব্রহ্ম যে কী জিনিস তা কেউ জানে না। ব্রহ্ম পরিবর্তনের কাজটি একজন দইতাপতি সেবকই করেন, যখন পুরীর মন্দিরে কেউ থাকেনা।"
পুরীর মন্দিরের ৪০কিমি পূর্বে কাকটপুর নামে এক গ্রামে দেবী মঙ্গলার পূজো অর্চনা করেন একদল দইতাপতি সেবক। প্রাচী নদীর তীরে একসময় দেবী মঙ্গলার মন্দির ছিল। বন্যার জন্য ওই মন্দির কিছুটা দূরে সরিয়ে নেওয়া হয়।
এখন মন্দিরটি মঠ হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। দেবী মঙ্গলার পুজোর পর দইতাপতি সেবকরা ওই মঠে নৃসিংহ মন্ত্র, স্বপ্নাবতী মন্ত্র বারংবার জপ করেন। এরপর স্বপ্নাদেশ পাওয়া শুধু সময়ের ব্যাপার। তারপর চারটি দলে বিভক্ত হয়ে দইতাপতিরা বেরিয়ে পড়েন সেই বৃক্ষগুলির সন্ধানে।
এই বিশেষ নিমগাছগুলো খু্ঁজে পাওয়ার পর সেগুলোর নিচে তিনদিন ধরে ব্রাহ্মণরা যজ্ঞ করবেন। একে বনযজ্ঞ বলে। যজ্ঞে নৃসিংহদেবের নামে আগুনে ঘৃত অর্পণ করা হয়। যথোচিত পূজো অর্চনার পর গাছগুলোকে কেটে কাঠের গাড়িতে চাপিয়ে পুরীর মন্দিরের কোইলি বৈকুণ্ঠে আনা হয়।
এরপর দইতাপতি সেবকদের কড়া নজরদারিতে কোইলি বৈকুণ্ঠের নির্মাণ মণ্ডপে নতুন দারু বিগ্রহের নির্মাণ পর্ব শুরু হয়। যাঁরা (চারজন) বিগ্রহগুলো নির্মাণ করেন তাঁদের বিশ্বকর্মা বলা হয়। এঁরাও দইতাপতি সেবক। বিগ্রহ নির্মাণ শুরুর আগে আরও একবার পূজো হয়। বিগ্রহগুলো নির্মাণের জন্য মোট ১৩ দিন সময় দেওয়া হয়।
বিগ্রহ নির্মাণ পদ্ধতি অনুযায়ী জগন্নাথদেব,বলভদ্র ও সুভদ্রার শ্রীঅঙ্গগুলোকে চার/পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়-শ্রীমুখ, হিয়া (হৃৎপিন্ড), পরিধাপানা (কোমর) ও শ্রীপায়ার (শ্রীচরণ)।
বিগ্রহগুলোর ব্রহ্ম পরিবর্তনের জন্য প্রতিটি শ্রীঅঙ্গে একটি ছোট গর্ত থাকে। শুদ্ধ আষাঢ় মাসের অমাবস্যার দিন চোখ বেঁধে ব্রহ্ম পরিবর্তনের কাজ সুসম্পন্ন করেন এক প্রবীন দইতাপতি। শোনা যায়, ব্রহ্ম পরিবর্তন কাজটি করার পর সেই দইতাপতি বেশিদিন বাঁচেন না।
এদিকে কোইলি বৈকুণ্ঠেই প্রায় ৯ হাত গভীর ও ৬ হাত ব্যসার্ধের একটি গর্তে রেশমের বস্ত্র ও তুলোর বালিশে তিন বিগ্রহ ও সুদর্শনকে শুইয়ে সমাধি দেওয়া হয়। আরেকটি কথা,
কোইলি বৈকুণ্ঠে বিগ্রহগুলোর নির্মাণ শেষ হলে আনুষ্ঠানিক ভাবে রত্নবেদিতে প্রতিষ্ঠার আগে তাঁদের অবয়বগত আরও কিছু প্রক্রিয়া থাকে।
সত্য যুগে যে প্রক্রিয়াতে অথবা যে নিয়ম মেনে চলে জগন্নাথের এইসব নীলা সম্পাদন করা হতো ঠিক বর্তমানেও পুরীতে গেলে সেই একই নিয়ম মেনে জগন্নাথের এসব কার্যক্রম সম্পাদন করা হয়। অনেকে এগুলোকে কাল্পনিক অথবা গল্প মনে করতে পারে। কিন্তু পুরীতে এগুলি বাস্তবে সংঘটিত হয়ে আসছে। জগন্নাথের নবকলেবর কি