নীলমাধব কে? পুরীধামে কিভাবে জগন্নাথ দেব আবির্ভূত হলেন? Who is Neelamadhav? Jagannath abirvab thithi
শাস্ত্র বলে ‘যেই গোর সেই কৃষ্ণ সেই জগন্নাথ নীলাচলে মহাপ্রভু জয় জগন্নাথ। নীলাচলধামে শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেব কিভাবে প্রকটিত হলো এটাই আজকের আলোচনার বিষয়ঃ
নীলমাধব কে?
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর প্রায় অনেকদিন কেটে গেছে।এদিকে শ্রীকৃষ্ণের বংশধরেরাও এমনকি ভগবান বলরামও স্বধানে প্রত্যাবর্তন করেছে । শ্রীকৃষ্ণ তখন দ্বারকায় । একদিন তিনি গাছের উপর পা ঝুলিয়ে বসে ছিলেন। তাঁর রাঙ্গা চরণকে টিয়া পাখি ভেবে ভুল করে বাণ মেরে বসল এক শবর। নাম ছিলো তার জরা। বাণের আঘাতেই অবশেষে বৈকুণ্ঠলোকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন কৃষ্ণ। কৃষ্ণকে বাণ মারা এটা ছিল অছিলা মাত্র । এ সব কিছুই ছিল পুর্বনির্ধারিত।
অপঘাতে শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর খবর পেয়ে অর্জুন ছুটে এলেন দ্বারকায়। দেহ সৎকারের সময় অর্জুন দেখলেন গোটা দেহটা পুড়লেও সখার নাভিদেশ তো আর পুড়ছে না !! তখনই হলো দৈববাণী ইনিই সেই পরমব্রহ্ম। অর্জুন, এঁকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করো। সমুদ্রেই ওঁর অনন্তশয়ন। অর্জুন তাই করলেন। ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলল পরমব্রহ্ম সেই নাভি।
আর তাকে লক্ষ করে সমুদ্রের তীর ধরে ছুটে চলল অনার্য সেই শবর জরা। শেষ অবধি তার বাণেই এই অবস্থা হল ভগবানের। দ্বারকা থেকে পুরী পর্যন্ত ছুটে চলা। অবশেষে এখানেই ভগবানকে স্বপ্ন দেখল সে কাল ভোরে আমাকে তুলে নে। এখন থেকে তোর বংশধর শবরদের হাতেই পুজো নেব আমি।
️তখন থেকে নীল মাধব রূপে তিনি পূজিত হতে থাকলেন শবরদের কাছে। সময়টা দ্বাপর যুগ। এরপর এলো কলি যুগ। স্কন্ধ পুরানে উল্লেখ্য রয়েছে ব্রম্মা থেকে আগত বংশ পরম্পরা ধারায় ২৫ তম পুরুষ হলেন ইন্দ্রদ্যুম্ন মহারাজ তিনি ছিলেন ভগবান জগন্নাথ দেবের অত্যন্ত প্রিয়ভক্ত। ভগবানের আদেশ অনুসারেই তিনি গড়ে তুললেন একটি মন্দির শ্রীক্ষেত্রে।
এখন আমরা তাকে চিনি জগন্নাথপুরি ধাম রূপে। কিন্তু মন্দিরে বিগ্রহ নেই! রাজসভায় একদিন কথা প্রসঙ্গে তিনি জানতে পারলেন নীল মাধবের কথা। ইনি নাকি বিষ্ণুরই এক রূপ। অমনি চারদিকে লোক পাঠালেন রাজা।
কিন্তু একে একে সবাই ফিরে এলেন ফিরলেন না একজন বিদ্যাপতি। তিনি জঙ্গলের মধ্যে পথ হারালে তাঁকে উদ্ধার করলেন সুন্দরী শবর কন্যা ললিতা। নিয়ে এলেন তাদের বাড়ি। ললিতা ছিলেন শবর রাজ বিশ্ববসুর কন্যা। ললিতার প্রেমে পড়লেন বিদ্যাপতি। বিয়ে হল দুজনের, বিয়ের পর বিদ্যাপতি আবিষ্কার করলেন রোজ সকালেই শবর রাজ কয়েক ঘণ্টার জন্য কোথাও উধাও হয়ে যান, আবার ফিরে আসেন। কোথায় যান বিশ্ববসু!
স্ত্রীকে প্রশ্ন করতে বিদ্যাপতি জানতে পারলেন জঙ্গলের মধ্যে একটি গোপন জায়গায় নীল মাধবের পূজো করতে যান শবররাজ বিশ্ববসু। নীলমাধবের সন্ধান যখন পাওয়া গেছে তখন আর ছাড়ার নয়। অমনি বিদ্যাপতি বায়না ধরলেন তিনিও দর্শন করবেন নীলমাধবকে। বিশ্ববসু প্রথমে রাজি না হলেও, অবশেষে মত দিলেন ,তবে শর্তসাপেক্ষে। বিগ্রহ পর্যন্ত চোখ বেঁধে যেতে হবে বিদ্যাপতিকে।
জামাতা হলেও বিদ্যাপতিকে কোন ভাবে নীলমাধবের সন্ধান দিতে রাজি ছিলেন না বিশ্ববসু। বিদ্যাপতিও ছাড়ার পাত্র নন। চোখ বাঁধা অবস্থায় যাওয়ার সময় তিনি গোটা পথটায় সরষের দানা ছড়াতে ছড়াতে গেলেন। যথাস্থানে পৌঁছে যখন তিনি দর্শন পেলেন নীলমাধবের তখন তাঁর প্রাণ আনন্দে ভরে উঠল।
️ বনের মধ্যে পূজোর ফুল কুড়িয়ে এনে বিশ্ববসু যখন পূজায় বসলেন অমনি দৈববাণী হল, হে বিশ্ববসু, এতদিন আমি তোমার পূজা গ্রহণ করেছি। আমি তোমার প্রতি অনেক প্রসন্ন কিন্তু হে বিশ্ববসু,এবার আমি মহাউপাচারে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের পূজো নিতে চাই। ভীষণ রেগে গেলেন শবররাজ। ইষ্টদেবতাকে হারাবার দুঃখে বন্দী করলেন বিদ্যাপতিকে।
️ কিন্তু কন্যা ললিতার বারবার কাকুতি মিনতিতে বাধ্য হলেন জামাতাকে মুক্ত করতে। বিদ্যাপতিও সঙ্গে সঙ্গে এই খবর পৌঁছে দিলেন রাজার কাছে। ইন্দ্রদ্যুম্ন মহানন্দে জঙ্গলের মধ্যে সেই গুহার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন ঠাকুরকে সাড়ম্বরে রাজপ্রাসাদে আনতে। কিন্তু একি! নীলমাধব কোথায়! কোথায় আমার নীলমাধব!!
জগন্নাথ দেব আবির্ভূত হলেন
ভাবে যখন নীলমাধবকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না তখন রাজা খুবই চিন্তিত হলেন কোন কিছু নাম ভেবে রাজা মাধবের কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন এবং শবররাজকে জিজ্ঞাসা করলেন । এবং পরে শবররাজকে বন্দী করলেন। তখন দৈববাণী হল যে সমুদ্রের জলে ভেসে আসবে দারু (কাঠ) রূপে সেই থেকেই বানাতে হবে বিগ্রহ। হাজার হাজারহাতি, ঘোড়া, সেপাইসাস্ত্রী, লোকলস্কর নিয়েও সমুদ্র থেকে তোলা গেল না সেই দারু। অবশেষে দারুর একদিক ধরলেন শবররাজ আর একদিক ব্রাহ্মণপুত্র ও বিদ্যাপতি। জগন্নাথের কাছে ব্রাহ্মণ-শবর কোনো ভেদাভেদ নেই যে!
️ মহারাজ তাঁর কারিগরদের লাগালেন মূর্তি গড়তে। কিন্তু সেই কাঠ এমনই পাথরের মত শক্ত যে ছেনি, হাতুড়ি সবই যায় ভেঙ্গে। তা হলে উপায়! মূর্তি গড়বে কে? মহারাজের আকুলতা দেখে ও জগন্নাথের আদেশে বৃদ্ধের বেশে এবার হাজির হলেন স্বয়ং বিশ্বকর্মা । তিনিই গড়বেন মূর্তি। তবে শর্ত একটাই। একুশ দিন আগে তিনি নিজে দরজা না খুললে কেউ যেন তাঁর ঘরে না আসে। শুরু হল কাজ। ইন্দ্রদ্যুম্নের রানী গুন্ডিচা রোজই রুদ্ধ দুয়ারে কান পেতে শোনেন কাঠ কাটার ঠক্ ঠক্ শব্দ। চোদ্দদিন পর হঠাৎ রানী দেখলেন রুদ্ধদ্বার কক্ষ নিস্তব্ধ। কী হল? তখন রানী মা ভাবতে লাগলো এই কারিগর একই তো ছিল বৃদ্ধ না জানি তার কি হল।
️ কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে রাণী মহারাজকে জানাতেই ইন্দ্রদ্যুম্ন খুলে ফেললেন কক্ষের দরজা। ভেতরে দেখেন বৃদ্ধ কারিগর ভিতরে নেই পড়ে আছে তিনটি অসমাপ্ত বিগ্রহ। তাদের হাত, পা কিছুই গড়া হয়নি। গর্হিত অপরাধ করে ফেলেছেন ভেবে দুঃখে ভেঙ্গে পড়লেন রাজা। তখন তাঁকে স্বপ্নাদেশ দিয়ে জগন্নাথ বললেন যে, এমনটা আগে থেকেই পূর্ব নির্ধারিত ছিল। তিনি এই রূপেই পূজিত হতে চান। সেই থেকেই শ্রী জগন্নাথদেবের বিগ্রহ ওভাবেই পূজিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে।
এভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো শ্রীজগন্নাথ, বলদেব এবং সুভদ্রা দেবীর বিগ্রহ। কিন্তু এই শ্রীজগন্নাথ, বলদেব এবং সুভদ্রা দেবীর বিগ্রহ সারা পৃথিবীতে শ্রীল প্রভুপাদ প্রতিষ্ঠিত ইসকন দ্বারা পরিচালিত প্রতিটি কেন্দ্রে স্থাপন করা হয়েছে।