নলকূবর-মণিগ্রীব উদ্ধার লীলা- নলকূবর-মণিগ্রীব উদ্ধার লীলা থেকে শিক্ষা Nalkubar-Manigriv rescue Leela

নলকূবর-মণিগ্রীব উদ্ধার লীলা- নলকূবর-মণিগ্রীব উদ্ধার লীলা থেকে শিক্ষা Nalkubar-Manigriv rescue Leela

কুবেরের দুই পুত্র নলকূবর ও মণিগ্রীব তারা ছিলেন শিবের মহান ভক্ত। কিন্তু তারা কেন নারদমূনির দ্বারা অভিশপ্ত হলেন এবং পরবর্তীতে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কিভাবে তাদের উদ্ধার করলেন সেটাই আজকের আলোচনার বিষয়ঃ 

 

      মা যশোদা তাঁর ছেলেকে বেঁধে রেখে গৃহকর্মে ব্যস্ত হলেন। তখন উদ্‌খলে বাঁধা শ্রীকৃষ্ণ বাড়ির সামনে দুটি অর্জুন বৃক্ষ দেখতে পেলেন। এ দুটি বৃক্ষের একটি ইতিহাস আছে। এরা ধনপতি কুবেরের পুত্র নলকূবর ও মণিগ্রীব। সাক্ষাৎ শিবের অনুচর হওয়া সত্ত্বেও এদের মাথায় কুবুদ্ধি প্রবেশ করে। তারা বারুণী সুধাপানে উন্মত্ত হয়ে দিগম্বর অবস্থায় জলে নেমে, প্রমত্ত হাতির মতো দেবাঙ্গনাদের সাথে জলক্রীড়া করতে লাগল। তখন নারদ মুনি সেদিকে আসছিলেন। তা দেখে দেবাঙ্গনারা তাদের স্বীয় বস্ত্র পরিধান করল। কিন্তু সেই পাষণ্ডদ্বয় নারদ মুনিকে উপেক্ষা করল। নারদ মুনি তাদের দুরাবস্থা দেখে করুণার্দ্র হলেন এবং বৃক্ষ যোনি প্রাপ্ত হয়ে চিরকাল নগ্ন থাকার অভিশাপ দিয়েছিলেন। তারাই সেই অর্জুন বৃক্ষদ্বয়। কৃষ্ণ ভাবলেন, “যদিও এরা কুবেরের পুত্র, এতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু যেহেতু নারদ মুনি এদের উদ্ধার করতে মনস্থ করেছেন, তাই এদের উদ্ধার করতে হবে। "

 

      শ্রীকৃষ্ণ উদ্‌খলে বাঁধা অবস্থায় তখন বৃক্ষ দুটির মাঝখান দিয়ে যাওয়া শুরু করলেন। এতে পেছনে বাঁধা উদূখলটি বক্রভাবে দুটি বৃক্ষে আটকে পড়ে । তিনি তখন প্রবল বিক্রমের প্রকাশরূপ অবলীলায় গাছ দুটি উপড়ে ফেললেন। সাথে সাথে বৃক্ষ দুটির মধ্য থেকে জ্যোতির্ময় দুই মহাপুরুষ প্রকাশিত হলেন। তাঁদের সৌন্দর্যের ছটায় সর্বদিক আলোকিত হয়েছিল এবং তাঁরা অবনত মস্তকে শ্রীকৃষ্ণকে প্রণতি জানিয়ে স্তুতি করতে লাগলেন ।

 

      শ্রীকৃষ্ণ তখন বললেন, “দেবর্ষি নারদ অত্যন্ত কৃপাময়। ধনমদে অন্ধ, তোমাদের দুজনকে অভিশাপ দিয়ে তিনি তোমাদের প্রতি তাঁর মহৎ কৃপা প্ৰদৰ্শন করেছেন। যদিও তোমরা স্বর্গ থেকে অধঃপতিত হয়ে বৃক্ষ যোনি প্রাপ্ত হয়েছিলে, তবুও তোমরা নারদমুনির কৃপাধন্য। সূর্যের আগমনে যেভাবে চক্ষুর অন্ধকার দূরীভূত হয়, তেমনি ঐকান্তিকভাবে আমার শরণাগত এবং আমার সেবায় কৃত সংকল্প ভক্তের সাক্ষাৎকারের ফলে, কারো আর জড় বন্ধন থাকতে পারে না। তোমরা দুজনে এখন গৃহে ফিরে যেতে পার। তোমরা যেহেতু সর্বদা আমার ভক্তিতে মগ্ন হতে চেয়েছিলে, তাই তোমাদের বাসনা পূর্ণ হলো, আর সেই স্তর থেকে তোমাদের কখনো অধঃপতন হবে না।”

 

      তখন তাঁরা কৃষ্ণকে প্রদক্ষিণ করে চলে গেলেন। কিন্তু নিকটে ক্রীড়ারত বালকেরা সব দেখছিল। এদিকে প্রচণ্ড বজ্রপাতের শব্দে বৃক্ষদ্বয় পড়ে যাওয়াতে নন্দ মহারাজ প্রমুখ গোপগণ নতুন বিপদের আশঙ্কা করে সেখানে এলেন। কিন্তু দুটি বৃক্ষকে পতিত দেখতে পেয়েও, তার কারণ নির্ণয় করতে অসমর্থ হলেন। কৃষ্ণতো সেখানে উদুখলে বন্ধ হয়ে আছে। তবে কে এই কাজটি করল?

 

     তখন সেই ছোট বালকেরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সবকিছু খুলে বলল। গভীর বাৎসল্য প্রেমের ফলে নন্দ মহারাজ প্রমুখ গোপগণ বিশ্বাস করতে পারেননি যে, শ্ৰীকৃষ্ণ এত আশ্চর্যজনকভাবে বৃক্ষ দুটি উৎপাটন করেছিলেন। কিন্তু কেউ কেউ ভাবতে লাগলেন, যেহেতু ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল যে, কৃষ্ণ নারায়ণের সমতুল্য হবে, তাই সে এই কার্য করেও থাকতে পারে।

 

     নন্দ মহারাজ তাঁর পুত্রকে রজ্জুবন্ধ অবস্থায় উদুখল নিয়ে টানাটানি করতে দেখে হাসতে হাসতে তাঁকে বন্ধনমুক্ত করেছিলেন। এই দামবন্ধন ও নলকূবর-মণিগ্রীব উদ্ধার লীলার মাঝেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ভক্তবশ্যতা' গুণ প্রদর্শন করলেন।

 

নলকূবর-মণিগ্রীব উদ্ধার লীলা থেকে শিক্ষা

 

       কুবেরের দুই পুত্র যদিও ছিলেন শিবের মহান ভক্ত, তবুও তিনটি কারণে নারদমুনির প্রতি তাদের আপরাধ হয় এবং পরিণামে তারা অধাপতিত হয়- (১) দম্ভ বা অহংকার, (২) নেশায় আসক্তি, (৩) যৌন সম্ভোগ ।

 

   ১. দম্ভ বা অহংকার: অত্যন্ত সুখদায়ক অনুকূল পরিবেশ সর্বদা আমাদের জন্য মঙ্গলজনক নয়। আমরা হয়ত অনেক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে তা কৃষ্ণের কৃপা বলে মনে না করে নিজের কৃতিত্ব বলে মনে করতে পারি। কিন্তু এই ঐশ্বর্য হতে জাত মিথ্যা অহংকার আমাদের পতনের অন্যতম কারণ।

 

   ২. নেশায় আসক্তি: কেউ যখন নেশায় আসক্ত হয়, তখন তার আর কোনো হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। মদিরা পান করে নলকূবর ও মণিগ্রীবেরও একই অবস্থা হয়েছিল।

 

   ৩. যৌন সম্ভোগ: গ্রীসঙ্গ আপাত সুখকর বলে মনে হলেও তা আমাদের ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনে । তাই শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর তার গোদ্রুম ভজনোপদেশে বর্ণনা করেছেন- রমণীজন-সঙ্গসুখঞ্চ সখে চরমে ভয়দং পুরুষার্থহরম। রমণীর সঙ্গে যে সুখ লাভ হয় তা চরমে অত্যন্ত ভয়ানক এবং তা আমাদের জীবনের পরম লক্ষ্যকে হরণ করে।

 

 <<>> কুবের পুত্ররা মন্দাকিনীতে (গঙ্গায়) গিয়ে কাম মোহিত হওয়ার ফলে গঙ্গাস্নান করেও দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। তাই কে কোথায় আছে তাঁর ওপর তার গন্তব্য নির্ধারিত হয় না, বরং মনোবৃত্তির ওপরই তার গন্তব্য নির্ণীত হয়। সুতরাং, গঙ্গাস্নান করতে গিয়েও যদি কারো মনোবৃত্তি শুদ্ধ না থাকে, তবে পাপ মুক্তি না হয়ে বরং আরো অপরাধ হয়, যা ভগবদ্ভক্তি লাভের প্রতিবন্ধক।

 

 <<>> ভগবানের শুদ্ধভক্ত বা সদগুরুর কৃপালাভ অত্যন্ত দুর্লভ। সাধুর কৃপাতেই ভগবানের কৃপা লাভ হয়। কিন্তু তাঁর প্রতি অপরাধের ফলে অবশ্যই দণ্ড পেতে হয়।

 

 <<>> দেহের সৌন্দর্য, উচ্চকূলে জন্ম এবং বিদ্যা প্রভৃতি উপভোগ্যের বিষয় তথ্য মদের মধ্যে ঐশ্বর্য বা ধনমদ সবচেয়ে ক্ষতিকর। কারণ, ধনমদে মত্ত মানুষ অজ্ঞতার ফলে তাদের ধনসম্পদ দ্বারা স্ত্রীসম্ভোগ, দ্যুতক্রীড়া এবং মদ্যপানে লিপ্ত হওয়ার অধিক সুযোগ প্রাপ্ত হয় ।

 

 <<>> ঐশ্বর্যের চারটি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে- ১. ইন্দ্রিয়সমূহকে বিক্ষিপ্ত করে ২. অহংকারী করে তোলে ৩. নিষ্ঠুরতা বাড়ায় এবং ৪. হাতে অর্থ থাকার ফলে সহজে জড় বাসনা চরিতার্থ করতে উদ্বুদ্ধ করে।

 

 <<>> ইন্দ্রিয় তর্পণের জন্য নগ্ন থাকার ফলে বৃক্ষ জন্ম লাভ করতে হয় ।

 

 <<>> ভক্তের অভিশাপও কৃপায় পর্যবসিত হয়। ধরুন, কোনো সন্তান ঘুমিয়ে আছে। এদিকে তার একটা রোগ সারানোর জন্য ওষুধ খাওয়ার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। তখন বাবা চিমটি কেটে সন্তানকে ঘুম থেকে তুলে ওষুধ খাওয়ায়। ঠিক তেমনি এখানে নারদমুনি নলকুবের ও মণিগ্রীবের জড় অন্ধত্ব দূর করার জন্য অভিশপ্ত করার মাধ্যমে তাদের আশীর্বাদ দিলেন। তিনি তাদের বৃক্ষযোনি প্রাপ্ত হওয়ার অভিশাপ দিলেন যাতে তারা আর পুনরায় কোনো পাপ কার্যে লিপ্ত হতে না পারে এবং পরে ভগবানের কৃপায় বৃক্ষশরীর থেকে মুক্ত হতে পারে।

 

 <<>> নারদমুনির হৃদয়ে অত্যন্ত করুণা ছিল, তাই তিনি অভিশাপ দিতে পেরেছিলেন। কারণ তিনি তাদের প্রকৃতই কল্যাণ চেয়েছিলেন। ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য ক্রোধবশত কখনো কাউকে অভিশাপ দেয়া বা কারো নিন্দা করা উচিত নয়। অবশ্যই অধিকার বুঝে নিন্দা বা সমালোচনা করা উচিত। যদি কেউ কল্যাণের উদ্দেশ্য চিন্তা না করেই সমালোচনা করে, তবে তা তার ধ্বংসের কারণ; যেমনটা হয়েছিল শিশুপালের ক্ষেত্রে।

 

 <<>> জন, ঐশ্বর্য, দ্রুত, শ্রী- কোনোটিই ভগবানকে সাক্ষাৎ দর্শন দান করতে পারে না। ভক্তের করুণার ফলেই কেবল ভগবৎ-দর্শন সম্ভব।

 

 <<>> যদি কেউ সরাসরি ভগবানের কাছে না গিয়ে ভক্তের মাধ্যমে ভগবানের কাছে যাওয়ার প্রয়াস করে, তবে সে শীঘ্রই সফল হবে। কারণ, ভগবানকে লাভ করার একমাত্র পন্থা ভক্তি। কিন্তু, ভগবান স্বয়ং সে ভক্তি দান করেন না। তিনি তাঁর ভক্তের যারাই সে ভক্তি দান করেন।

 

 <<>> শ্রীমদ্ভাগবতে (১/২/১৬) বলা হয়েছে- স্যান্মহৎসেবয়া বিপ্ৰা পূণ্যতীর্থানিষেবণাৎ। অর্থাৎ সব রকমের পাপ থেকে মুক্ত ভগবদ্ভক্তদের সেবা করার ফলেই কেবল মহৎসেবা সাধিত হয়। আবার, শ্রীমদ্ভাগবতে (৫/১২/১২) জড় ভরত মহারাজ রগণকে বলেছেন- “মহাজনের শ্রীপাদপদ্মের ধূলিকণার দ্বারা অভিষিক্ত না হলে তপস্যা, বৈদিক অৰ্চনাদি, সন্ন্যাস পালন, গার্হস্থ্য-ধর্ম পালন, বেদপাঠ অথবা জল-অগ্নি-সূর্যের পূজা দ্বারা কখনোই ভক্তি লাভ করা যায় না।”

 

 <<>> ভগবান তাঁর অনন্তস্বরূপে অনন্তনীলার মাধ্যমে তাঁর ভক্তকে আনন্দ প্রদান করেন। আমাদের উচিত, ভগবানের এ সকল অমৃতময় লীলা শ্রবণের মাধ্যমে আবার আমাদের চিন্নায় স্বরূপে ভগবানের কাছে ফিরে যাওয়ার প্রয়াসী হওয়া।