পানিহাটি চিড়া দধি মহোৎসব মাহাত্ম্য। চিড়া দধি মহোৎসব কি এবং কেন পালন করা হয়। বৈষ্ণব অপরাধ থেকে মুক্তি লাভ।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ও শ্রীমান নিত্যানন্দ মহাপ্রভু এই ধরাধামে বদ্ধ জীবদের শুদ্ধ প্রেম ভক্তি দান করার জন্য অনেক দিব্য নিলা করে গেছেন সেই দিব্য নীলা সমূহের মধ্যে পানিহাটি চিড়া দধি মহোৎসব অন্যতম এটাই আজকের আলোচনার বিষয়ঃ
উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলায় সোদপুর স্টেশন থেকে অনতিদূরে গঙ্গাতীরে পানিহাটি গ্রাম। প্রায় ১৫১৪-১৫ খিষ্টাব্দের কথা। রঘুনাথ দাস গোস্বামী ছিলেন জমিদার পরিবারের একমাত্র ছেলে। তাদের অনেক বিষয় সম্পত্তি ছিল তার স্ত্রী ছিলেন পরম সুন্দরী। কিন্তু তার এই জাগতিক ভোগ বিলাসে কোনমতেই মন ছিল না। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন এসব কিছু ছেড়ে চলে যাবেন। তাই তিনি তার বাবার বিষয় আশয় সব ছেড়ে মহাপ্রভুর চরণে কৃষ্ণভক্তি প্রেম লাভ করতে চাইলেন। তার পিতা অনেক চেষ্টা করেও ছেলেকে সংসারে রাখতে পারলেন না।
একবার শ্রীল রঘুনাথ গোস্বামী মহাপ্রভুর সাথে সাক্ষাতের চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন।একদিন তিনি জানতে পারলেন পানিহাটিতে রাঘব পন্ডিতের বাড়িতে শ্রীমন নিত্যানন্দ প্রভু উপস্থিত হয়ে অনেক ভক্তদের নিয়ে কীর্তন করছেন। রঘুনাথ দাস গোস্বামী নিত্যানন্দ প্রভুকে দর্শন করবার জন্য পানিহাটি আসেন। তিনি দেখলেন গঙ্গার তটে এক বটবৃক্ষের তলে বেদীর উপর শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু বসে আছেন।
তিনি কোটি কোটি সূর্যের মতো জ্যোর্তিময়। তাঁকে পরিবেষ্টন করে বহু ভক্ত বসে আছেন। দূর থেকে রঘুনাথ দাস গোস্বামী শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুকে দন্ডবৎ করে পড়ে রইলেন। কোনো ভক্ত শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুকে বললেন, রঘুনাথ আপনাকে প্রণতি নিবেদন করছে। তা শুনে নিত্যানন্দ প্রভু বললেন, ‘ওরে চোর, এতদিনে তুই দেখা দিলি। আয় আয় আমি তোকে দন্ড দেব।’ নিত্যানন্দ প্রভু কাছে ডাকলেও রঘুনাথ দাস তাঁর কাছে যাচ্ছিলেন না। তখন নিত্যানন্দ প্রভু জোর করে তাঁকে ঘরে আনলে রঘুনাথ প্রণতি নিবেদন করলেন। নিত্যানন্দ প্রভু শ্রীচরণপদ্ম তার মস্তকে স্থাপন করলেন। এবং শ্রী নিত্যানন্দ প্রভু কৌতুক করে বললেন যেহেতু রঘুনাথ পালিয়ে পালিয়ে সরাসরি মহাপ্রভুর স্মরণ আশ্রয় নিতে চেয়েছিল তাই তার অপরাধ হয়েছে।
আজ তোর নাগাল পেয়েছি। তোকে দন্ড দেব। আমার ভক্তদেরকে এখন চিড়দধি খাওয়াতে হবে।’ সেই কথ শুনে রঘুনাথ দাস অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে তৎক্ষণাৎ তার ভক্তদেরকে পাঠিয়ে চিড়া, দধি, দুধ. সন্দেশ, চিনি ও কলা প্রভৃতি দ্রব্য কিনে আনলেন এবং বিভিন্ন গ্রাম থেকে সেইসব দ্রব্য এনে সাজালেন, চারশোটি গোল হোলনা আনলেন। পাঁচ সাতটি বিশাল বিশাল মাটির পাত্র আনালেন। সেগুলিতে এক ব্রাহ্মণ চিড়া ভিজাতে লাগলেন। দুধ গরম করে এনে তাতে চিড় ভেজানো হলো। কোনো পাত্রে দধি, চিনি, কলা মেশানো হলো। অন্য পাত্রে ঘন দুধের সাথে কলা, চিনি, ঘি ও সামান্য কর্পূর মিশানো হলো। এভাবে সাতটি বড় বড় পাত্র এনে নিত্যানন্দ প্রভুর সামনে রাখা হলো।
চাতালের উপর শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু বসে আছেন, তাঁর চতুর্দিকে তাঁর নিজজন বড় বড় সমস্ত লোকেরা মন্ডলী রচনা করে বসে আছেন। চিড়াদধি উৎসবের কথা শুনে যত ব্রাহ্মণ, পুরোহিত, পন্ডিত এসেছিলেন শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু তাদের সবাইকে চাতালের উপর বসালেন।
সবাইকে দুটি করে হোলনা দিয়েছিল যার একটিতে দুধ চিড়া, অন্যটিতে দধি চিড়া দেওয়া হয়েছিল। চাতালের তলায় মন্ডলাকারে অসংখ্য ভক্ত বসেছিল। অনেক অনেক ব্রাহ্মণ চাতালে জায়গা না পেয়ে চাতালের নিচে বসলেন। সেখানে অনেকে স্থান না পেয়ে জলের ধারে বসেছিলেন। সেখানেও অনেকে স্থান না পেয়ে জলে নেমে গিয়ে হোলনাগুলো জলের উপর ভাসিয়ে ধরে রাখার চেষ্টা করলেন। কুড়িজন পরিবেশনকারী সবাইকে চিড়াদধি দিতে লাগলেন। সবাইকে চিড়াদধি দেওয়া হলেও কেউই ভোজন করছিলেন না। কারণ সেই সমস্ত ভক্তের মনোভিলাষ এই যে, নিত্যানন্দ প্রভু আগে ভোজন শুরু করবেন, তারপর তাঁর নির্দেশক্রমে আমরা ভোজন শুরু করব। ঠিক সেই সময় সেখানে এসে পৌঁছালেন রাঘব পন্ডিত গোস্বামী।
তিনি সেই বিশাল মহোৎসব দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে হাসতে লাগলেন। তিনিও নানা রকমের প্রসাদ নিয়ে এসে নিত্যানন্দ প্রভুকে বললেন,“আপনার জন্য আমি গৃহে ভোগ নিবেদন করেছি, আর এখানে উৎসব! এদিকে আমার ঘরে প্রসাদ রয়েছে।” নিত্যানন্দ প্রভু বললেন, তোমার ঘরে আমি রাত্রে প্রসাদ পাবো। আমি জাতিতে গোপ তাই নদীর তীরে এই গোপদের সঙ্গে পুলিন ভোজন করতে আমার খুব আনন্দ হয়। এই দুটি হোলনা নিয়ে তুমি আমাদের সাথে প্রসাদ পাও। অসংখ্য ভক্তমন্ডলীর কাছে চিড়াদধি থাকলেও কেউই ভোজন করছিলেন না। নিত্যানন্দ প্রভুর ধ্যানের মাধ্যমে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে নিয়ে এলেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এলেন আর নিত্যানন্দ প্রভু দাঁড়িয়ে পড়লেন।প্রত্যেকের চিড়াদধি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। প্রতিটি পাত্র থেকে এক এক গ্রাস করে চিড়া তুলে নিয়ে তিনি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মুখে দিতে লাগলেন।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুও মৃদু মৃদু হেসে এক এক গ্রাস চিড়া তুলে নিয়ে নিত্যানন্দ প্রভুর মুখে দিলেন। এভাবে তাঁরা হাসতে হাসতে পরস্পর পরস্পরকে খাওয়াতে লাগলেন। এভাবে নিত্যানন্দ প্রভু সব মন্ডলে বেড়াতে লাগলেন এবং সমস্ত বৈষ্ণবগণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই লীলা দর্শন করতে লাগলেন। কোন কোন ভাগ্যবান সেই ব্যাপার লক্ষ্য করছিলেন। অনেকেই বুঝতেই পারছিলেন না নিত্যানন্দ প্রভু কি করছেন? কারণ অনেকেই চৈতন্য মহাপ্রভুকেই দেখতে পাচ্ছেন না। তারপর নিত্যানন্দ প্রভু আসনে বসলেন, মহাপ্রভুকে বসালেন। আনন্দে নানা ভাবাবেশে নিত্যানন্দ প্রভু সবাইকে নির্দেশ দিলেন হরিনাম উচ্চারণ করতে করতে তোমরা সকলে ভোজন কর। তখন হরি হরি ধ্বনিতে আকাশ বাতাস পরিপূর্ণ হলো। নিত্যানন্দ প্রভু আগে মুখে গ্রাস তুললেন, তখন অন্যরা ভোজন করতে শুরু করলেন।
সেই সময় ভোজনকারী বৈষ্ণবগণের প্রত্যেকের মনে পানিহাটি কিংবা গঙ্গাতটের কথা মনে হলো না, মনে হলো বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামের সাথে তারা সব গোপসখা যমুনার তীরে পুলিনভোজন করছেন। এদিকে সেখানে মহোৎসব হচ্ছে শুনে দূরের, পাশের সমস্ত গ্রাম থেকে অনেক ভক্ত বহুল পরিমাণে চিড়া, দই, সন্দেশ, প্রভূতি নিয়ে এসে পৌঁছাল। যে যা নিয়ে এল, রঘুনাথ দাস গোস্বামী তাদের সমস্ত মূল্য দিয়ে সেগুলি ক্রয় করলেন এবং তাদেরই সেগুলি খাওয়ালেন। অসংখ্য ভক্ত সেখানে মজা দেখতে আসতে লাগল, তাদেরকেও চিড়া দধি কলা খাওয়ানো হলো।
তাঁর কাছে চারটি কুন্ডিতে অবশেষ প্রসাদটি রঘুনাথ গোস্বামীকে দিয়েছিলেন, বাকী তিনটি কুন্ডি থেকে অবশেষ প্রসাদ একটু একটু করে নিয়ে এক ব্রাহ্মণ অন্য সমস্ত ভক্তকে দিতে লাগলেন। রঘুনাথ দাস গোস্বামীও প্রভুর দেওয়া অবশেষ প্রসাদ তাঁর ভক্তদের বন্টন করতে লাগলেন। তারপর একটু বিশ্রাম নিয়ে সন্ধাকালে শুরু হলো শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর মহা হরিনাম সংকীর্তন। ভগবৎ প্রেমে যেন জগত প্লাবিত করছেন। অনেকেই সেখানে নিত্যানন্দ প্রভুর সঙ্গে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে নাচতে দেখলেন, আবার অনেকে মহাপ্রভুকে দেখেননি। তাঁরা জানেন, মহাপ্রভু তো জগন্নাথপুরী ধামে রয়েছেন। যাই হোক, সেই চিড়া দধি মহোৎসবে রঘুনাথ দাস গোস্বামী সহ সমস্ত ভক্ত পরম আনন্দে বিহ্বল হলো।
সেই চিড়াদধি মহোৎসব স্মৃতি অনুসারে প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্লা ত্রয়োদশী তিথিতে এই পানিহাটিতে সেই বটবৃক্ষতলে চিড়াদধি মহোৎসব হয়। কিন্তু বর্তমানে সারা পৃথিবীতে এসি ভক্তিবেদান্ত স্বামী শ্রীল প্রভুপাদের কৃপায় প্রতিটি ইসকন মন্দিরে এই চিড়া দধি মহোৎসব পালিত হয়ে আসছে তাই আপনারা চিড়া দধি মহোৎসবে আপনাদের নিকটস্থ ইসকন মন্দিরে যোগদান করবেন। এবং জগন্নাথ বলদেব সুভদ্রা মহারানীর তথা গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর মহা প্রসাদ আস্বাদন করে মানব জীবন ধর্ম ধন্য করবেন ।হরে কৃষ্ণ