প্রহ্লাদ মহারাজ কি কারনে এত বড় শুদ্ধ ভক্তে পরিণত হলেন। প্রহ্লাদ মহারাজের জীবনী

প্রহ্লাদ মহারাজ কি কারনে এত বড় শুদ্ধ ভক্তে পরিণত হলেন। প্রহ্লাদ মহারাজের জীবনী

  অসুররাজ হিরণ্যকশিপুর পুত্র ছিলেন প্রহ্লাদ মহারাজ। কিন্তু প্রহ্লাদ মহারাজ কেন অসুর কুলে জন্মগ্রহণ করলেন এবং কেমন করে তিনি ভগবানের এত বড় শুদ্ধ ভক্তে পরিণত হলেন কে এই প্রহ্লাদ মহারাজ এবং তিনি পূর্ব জন্মে কে ছিলেন। এই প্রশ্নটি এক সময় প্রহ্লাদ মহারাজের নিজের ছিল তাই তিনি একবার ভগবান নৃসিংহদেব কে জিজ্ঞাসা করে বলেছেন। 

 

   প্রহ্লাদ  বললেন, হে ভগবান, হে নৃসিংহদেব, হে সকল দেবগণের আরাধ্য প্রভু আপনাকে প্রণাম জানাই। প্রহ্লাদ মহারাজের জীবনী 

 

আমি জিজ্ঞাসা করছি, হে প্রভু, তোমার প্রতি আমার ভক্তি কিরূপ উৎপন্ন হল? কিরূপ আমি তোমার প্রিয় ভক্ত হলাম?

 

    শ্রীনৃসিংহদেব বললেন, হে বুদ্ধিমান একান্ত মনে শোনো। প্রাচীন কল্পে তুমি ব্রাহ্মণ ছিলে, কিন্তু বেদপাঠ করনি। তোমার নাম ছিল বসুদেব এবং তুমি ছিলে বেশ্যাসক্ত। তোমার কোন সুকর্ম ছিল না, কেবল একটি মাত্র আমার ব্রত করেছিলে। সেই ব্রত প্রভাবে তোমার এরকম আমার প্রতি ভক্তি হয়েছে।

 

     প্রহ্লাদ বললেন, হে নৃসিংহ, হে অচ্যুত, হে প্রভু, আমি কার পুত্র হয়ে কি করতাম? বেশ্যাসক্ত অবস্থায় কিভাবে তোমার ব্রত করলাম? দয়া করে বলুন।

 

      শ্রীনৃসিংহদেব বললেন, ""পুরাকালে অবন্তীপুরে এক বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ ছিল। তার নাম ছিল বসুশর্মা। ধর্মপরায়ণ ও বৈদিক ক্রিয়া অনুষ্ঠানে তৎপর। তার ভার্যা জগৎ প্রসিদ্ধা সুশীলা পতিব্রতা সদাচারিণী। তাদের পাঁচ পুত্র ছিল। চারজন ছিল সদাচারী, বিদ্ধান, পিতৃভক্ত। কিন্তু কনিষ্ঠ পুত্রটি ছিল অসদাচারী, সর্বদা বেশ্যাসক্ত, সুরাপায়ী। সেই কনিষ্ঠ পুত্রটি ছিলে তুমি। নিত্য বেশ্যাগৃহেই তুমি বসবাস করতে। এক বনমধ্যে তুমি ও সেই তোমার বান্ধবী বেড়াতে গিয়েছিলে। তোমরা মনে করেছিলে দিনটি বেশ ভালোই কাটবে। কিন্তু তোমাদের নিজেদের মধ্যে চরিত্র বিষয়ে বিশেষ রকমে কলহ বেধে যায়। তোমাদের মধ্যে মনোমালিন্যের কারনে মৌনভাবে তোমরা আলাদাভাবে একটি স্থানে এসে বসেছিলে। সেখানে তুমি অতি পুরানো ধ্বংসাবশেষ গৃহ নিদর্শন স্বরূপ কিছু ইট পাথর দেখেছিলে। সেই নির্জন স্থানে আলাদাভাবে উপবেশন করে তোমরা দুইজন ক্রন্দন করছিলে আপন আপনভাবে। সারাদিন তোমরা

অনাহারী ছিলে, এমনকি জল পর্যন্ত পান করনি। সারারাতও তোমরা জাগরিত ছিলে। ক্লান্ত শরীরে দুঃখিত অন্তরে মনোমালিন্য ভাবে তুমি সেখানে শুয়ে পড়ে প্রার্থনা করছিলে,

 

      হে ভগবান, হে শ্রীহরি, এই জগতের কত লোক সুন্দর! আমার মা-বাবা কত সুন্দর ধর্মপ্রাণ। আমার ভাইয়েরা কত সুন্দর। তাঁরা নিষ্ঠাবান, চরিত্রবান। কিন্তু আমি অধঃপতিত। আমি মহা মন্দমতি। আমি চরিত্রহীন। পথের পাগলের চেয়েও অধপতিত। হে ভগবান, ভাল লোকেরা তোমার শরণাগত। আমি মূর্খ। কারো শরণাগত নই। আমি নিঃসঙ্গ। আমি বড় অসহায় অবস্থায় তোমার কাছে প্রার্থনা করছি, হে ভগবান, আমাকে বিশুদ্ধ জীবন দান করো।"

 

     এভাবে তুমি ক্রন্দন করছিলে। আর তোমার বান্ধবী, সেও একান্ত মনে প্রার্থনা করছিল, "হে ভগবান, আমি এই সমাজের মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য স্তরের জীব। সভ্য সমাজ থেকে আমি বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন। এই জগতে অনেক নিষ্ঠাবতী সাধ্বী সুন্দরী নারী রয়েছে। আর আমি মহাপাপী গণিকাবৃত্তি করেই জীবন নষ্ট করেছি। প্রতিদিনই কেবল পাপের বোঝা বাড়িয়েছি। নরকযাতনা কতই না এই পোড়া কপালে অপেক্ষা করছে। ভদ্র সমাজে কেউ কোনওদিন আমাকে তাকাতেও চায় না। আমিও এই জগতের কোনও পথ খুঁজে পাই না। হে পরম করুণাময় নৃসিংহদেব ভগবান, যদি তোমার অহৈতুকী

কৃপাদৃষ্টি আমার প্রতি থাকে তবে দয়া করে আমার এই জীবন পরিবর্তন করে দাও।" এভাবে সে আকুল অন্তরে ক্রন্দন করতে লাগল।""

 

     ভগবান শ্রীনৃসিংহদেব বললেন, ‘হে প্রহ্লাদ, সেই স্থানটি ছিল আমার প্রাচীন মন্দির। সেই দিনটি ছিল বৈশাখ মাসের শুক্লা চতুর্দশী- আমার আবির্ভাবের দিন। তোমরা উপবাসী ছিলে, রাত্রি জাগরণ করেছিলে, জীবনের কল্যাণ প্রার্থনা করেছিলে। অর্থাৎ অজ্ঞাতসারেই তোমরা আমার পরম-মঙ্গলময় চতুর্দশী ব্রত পালন করেছিলে। সেই ব্রত প্রভাবে তুমি এ জন্মে আমার প্রিয় ভক্তরূপে জন্মগ্রহণ করেছ। আর সেই বেশ্যাও এই ব্রত প্রভাবে স্বর্গলোকে অপ্সরা জীবন লাভ করে ত্রিভুবনে সুখচারিণী হয়েছে।

 

     হে প্রহ্লাদ! আমার ব্রতের প্রভাব শোনো। সৃষ্টিশক্তি লাভের উদ্দেশ্যে ব্রহ্মা আমার এই চতুর্দশী ব্রত পালন করেছিলেন। ত্রিপুরাসুরকে বধের উদ্দেশ্যে মহাদেব এই ব্রত করেছিলেন, স্বর্গসুখ লাভের জন্যই দেবতারা আগের জন্মে আমার ব্রত করেছিলেন।

 

     যে সমস্ত মানুষ আমার এই ব্রতশ্রেষ্ঠ পালন করবে, শতকোটি কল্পেও তাদের সংসার পুনরাগমন হবে না। আমার ব্রত প্রভাবে অপুত্রক ভক্ত পুত্র লাভ করে, দরিদ্র ধনশালী হয়, তেজস্কামী তেজঃলাভ করে, রাজ্যকামী রাজ্য পায়, আয়ুস্কামী দীর্ঘায়ু লাভ করে, স্ত্রীলোকেরা আমার এই চতুর্দশী ব্রত পালন করলে ভাগ্যবতী হয়, এই ব্রত সৎপুত্র প্রদ, ও পুত্রশোক বিনাশন,দিব্য সুখ প্রদ।

 

স্ত্রী-পুরুষ যারা এই উত্তমব্রত পালন করে, তাদের আমি সুখ ও ভুক্তি-মুক্তি ফল দান করি।

 

হে প্রহ্লাদ, দুরাত্মাদের আমার ব্রত পালনে মতি হয় না। পাপকর্মেই সর্বদা তাদের মতি।""

 

প্রহ্লাদ মহারাজ করোজোরে বললেন হে নৃসিংহদেব প্রভু, জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে করা সকল অপরাধ ক্ষমা করো ভগবান। হে ভগবান তোমাতে একান্ত ভক্তি প্রদান করো। পরম ভক্ত প্রহ্লাদ

 

বৃহৎনারদীয়সিংহ পুরাণে ভগবান শ্রীনৃসিংহদেব পরম ভক্ত প্রহ্লাদকে বললেন-

 

                        বর্ষে বর্ষে তু কর্তব্যং মম সন্তুষ্টি কারণম।

                         মহা গুহ্যমিদং শ্রেষ্ঠং মানবৈর্ভব ভীরুভিঃ।

 

   অনুবাদঃ প্রতি বছর আমার সন্তুষ্টি উদ্দেশ্যে নৃসিংহ চতুর্দশী ব্রত্য কর্তব্য। জন্ম-মৃত্যুময় সংসার ভয়ে মানুষ এই পরম গোপনীয় ও শ্রেষ্ঠ ব্রত পালন করবে।

 

     বৈশাখ মাসের শুক্লা চতুর্দশীতে শ্রীনৃসিংহদেব আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাই এই তিথিতে ব্রত পালন পূর্বক তার পূজা ও উৎসব করতে হয়।

 

     আমরা পরবর্তীতে আলোচনা করব ভগবান নৃসিংহদেব কেন আবির্ভূত হয়েছেন, কেন নৃসিংহ চতুর্দশী পালন করতে হবে, নৃসিংহ চতুর্দশী মাহাত্ম্য কি এবং কিভাবে পালন করতে হবে। নৃসিংহ স্তব, ধ্যান, প্রণাম মন্ত্র এবং ভগবান নৃসিংহদেবকে কি নিবেদন করতে হবে।