পুরুষোত্তম মাসের মাহাত্ম্য এবং দ্রৌপদীর পূর্ব জন্ম লীলা-The greatness of the month of Purushottam
চান্দ্রমাস ও সৌরমাস গণনায় মিল রাখার জন্য প্রতি ৩২ মাসে একটি মাস অতিরিক্ত হয়। সেই | মাসটির নাম ‘অধিমাস'। শাস্ত্রানুসারে একটি বৎসরকে দ্বাদশ মাসে ভাগ করে বারো মাসে সকল প্রকার সৎকর্ম ও পূজা-পার্বণের নির্ঘণ্ট করা হয়েছে। বর্ণাশ্রমগত সমস্ত কর্মই যখন বারোটি মাসে বিভক্ত হলো, তখন ‘অধিমাস' কর্মহীন হয়ে গেল। কেননা, অধিমাসে কোনোরকম পুণ্যকর্মের বিধান শাস্ত্রে দেখা যায় না। যেহেতু এই মাসে কেনো প্রকার | কর্মকাণ্ডীয় ক্রিয়ানুষ্ঠান পালিত হয় না, তাই স্মাতবাদী পণ্ডিতেরা অধিমাসকে ‘মলমাস’ বা ‘মলিনমাস' বলে ঘৃণা করে। কিন্তু পরমার্থ শাস্ত্র এই অধিমাসটিকে সর্বোপরি শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা করেছে। জীবনের কোন অংশেই বৃথা যাপন করা উচিত নয়। সর্বদা হরিভজন করাই জীবনের কর্তব্য। আবার যেহেতু এই মাসটি সকল প্রকার কর্মশূন্য, তাই সেটি হরিভজনের জন্য অধিক উপযোগী। গোলোকাধিপতি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং এই মাসকে কার্তিক, মাঘ ও বৈশাখ আদি মহাপুণ্য মাস অপেক্ষা | সর্বশ্রেষ্ঠ মাস বলে স্থাপন করেছেন। আজকে আমরা আলোচনা করব পুরুষোত্তম মাসের মাহাত্মক কথা নিয়ে-
পুরুষোত্তম মাসের মহিমা-
পদ্মপুরাণেও পুরুষোত্তম মাস মহিমা বিস্তৃতরূপে বর্ণিত আছে। একদা নৈমিষারণ্যে হাজারো ঋষি সমবেত হয়ে তপস্যা করছিলেন। সৌভাগ্যবশত, সেখানে সুত গোস্বামী সশিষ্য উপনীত হলেন। মুনিগণ তাঁকে দেখতে পেয়ে তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে | সম্মান প্রদর্শন করলেন এবং একটি উত্তম ব্যাসাসনে বসতে দিলেন।
মুনিগণ করজোড়ে বলতে লাগলেন, “হে সূত গোস্বামী! আমরা পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চমৎকার ও আশ্চর্যকর লীলাকাহিনী শ্রবণ করলাম। বৈদিক জ্ঞান অত্যন্ত জটিল ও রহস্যময়। তাই প্রশ্ন,কীভাবে এই ভবসমুদ্র থেকে উদ্ধার পেয়ে ভগবদ্ধামে ফিরে যেতে পারব”?
শৌনকাদি ঋষিদের অনুরোধ শ্রবণ করে সুত গোস্বামী বলতে লাগলেন, “হে মুনিগণ, তবে শোনো। আমি সর্বপ্রথম পুষ্কর | তীর্থে গিয়েছিলাম, তারপর হাজারো তীর্থভ্রমণ করে হস্তিনাপুরে পৌঁছাই। সেখানে গঙ্গাতীরে হাজারো ঋষি প্রায়োপবেশনে ছিলেন। তখন হঠাৎ শুকদেব গোস্বামী সেখানে আসাতে সবাই করজোড়ে তাঁকে সম্ভাষণ জানালেন। তারা শুকদেব গোস্বামীকে একটি ব্যাসাসনে বসালেন। তিনি পরীক্ষিত মহারাজকে ভগবত কথা শ্রবণ করালেন। এখন আমি আপনাদের ভগবানের সর্বাকর্ষক লীলা বলব।”
একবার শ্রীনারদ মুনি বদ্রিকাশ্রমে শ্রীনারায়ণ ঋষির কাছে গিয়েছিলেন। তাঁর পাদপদ্ম থেকে অলকানন্দা প্রবাহিত হচ্ছিল। নারদ মুনি নারায়ণ ঋষিকে দণ্ডবৎ প্রণতি জ্ঞাপনপূর্বক প্রার্থনা করলেন, “হে দেবেশ্বর! হে দয়ানিধে! হে লোকস্ৰষ্টা! আপনি পরমসত্য। আপনাকে আমার প্রণতি নিবেদন করছি”। “হে ভগবান! এই জড়জগতে সবাই ইন্দ্রিয় তর্পণে কতই না ব্যস্ত। তারা জীবনের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণরূপে ভুলে গেছে।
তাই এসমস্ত গৃহস্থ ও আমার মতো পরিব্রাজক সন্ন্যাসীদেরও আচরণীয় এমন কোন একটি পন্থা বলুন, যাতে আত্মোপলব্ধি লাভ করে ভগবদ্ধামে ফিরে যাওয়া যায়।” নারদের মধুর বচন শুনে নারায়ণ হাসলেন। তিনি বললেন,”হে নারদ, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত লীলা শ্রবণ কর, এতে তোমার সমস্ত পাপরাশি ধ্বংস হবে। আমি জানি, তুমি এটা পুর্ণরূপে অবগত আছো। কিন্তু জনকল্যাণার্থে আবারো জিজ্ঞাসা করছ। তাই আমি তোমাকে পুরুষোত্তম ব্রতের মহিমা বলছি। এটা শুধু জাগতিক সুখই প্রদান করবে না। ভগবদ্ধামে ফিরে যাবার যোগ্যতাও প্রদান করবে।”
নারদজী বললেন, “হে ভগবান! আমি কার্তিক, চৈত্র প্রভৃতি সকল মাসেরই মহিমা শুনেছি। কিন্তু এই পুরুষোত্তম মাসটা আবার কী? হে দয়ানিধি, আমাকে এই পবিত্র মাস সম্পর্কে বলুন। কীভাবে এই মাসে ব্রত উদযাপনকরতে হয়? কীভাবে এ মাসকে মহিমান্বিত করা উচিত? আমি কি মন্ত্র জপ করবো? আমাকে খুলে বলুন। " শ্রীনারায়ণ বললেন, “নারদ! পূর্বে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ-যুধিষ্ঠির সংবাদে এ বিষয়ে আলোচিত হয়েছিল। একবার ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির তাঁর সাম্রাজ্য রাজপ্রাসাদ এমনকি দ্রৌপদীকেও পাশাখেলায় পণ রেখেছিলেন। দুর্যোধনের নিকট সে খেলায় যুধিষ্ঠির হেরে গিয়েছিলেন। তখন রাজসভায় দুঃশাসন কর্তৃক দ্রৌপদী অপমানিত হয়েছিলেন। কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তখন বস্ত্রহরণজনিত লজ্জা থেকে দ্রৌপদীকে বাঁচিয়েছিলেন। যুধিষ্ঠির মহারাজ তখন স্ত্রী ও ভ্রাতাগণসহ কাম্যবনে বাস করতে শুরু করেন।
কেন পালন করব পুরুষোত্তম মাম-
একবার দেবকীনন্দন শ্রীকৃষ্ণ, সেই বনে পাণ্ডবদের দেখতে গেলেন। পাণ্ডবেরা ভগবানকে দেখে বনবাসের সমস্ত দুঃখ ভুলে গেলেন। তারা ভগবানকে প্রণতি নিবেদন করলেন। তাঁদের দুঃখ দেখে কৃষ্ণ অত্যন্ত বিমর্ষ হলেন, আর দুর্যোধনের প্রতি সক্রোধ বচনে কঠোর বাক্য বলতে লাগলেন। তখন মনে হলো ভগবান যেন সমস্ত সৃষ্টিকে ধ্বংস করে দেবেন। তাই পাণ্ডবেরা ভগবানের নিকট বিনম্র প্রার্থনা নিবেদন করলেন। অর্জুনের বিনম্র প্রার্থনা শ্রবণ করে ভগবান শান্ত হলেন এবং বলতে লাগলেন, “হে অর্জুন! তোমাদের সবাইকে দর্শন করে এবং তোমাদের ভক্তিতে, ভালোবাসায় আবদ্ধ হয়ে আমি এখন তোমাদের পুরুষোত্তম মাসের অত্যাশ্চর্য মহিমা বর্ণনা করব।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখে পুরুষোত্তম মাসের মহিমা শ্রবণ করতে পাণ্ডবেরা অত্যন্ত উৎফুল্ল হলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, যুধিষ্ঠির ও দ্রৌপদীর দিকে করুণা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অর্জুনকে বলতে লাগলেন, “হে পুরুষব্যাঘ্র, তোমরা কি তোমাদের দুঃখের কারণ জানো? তোমরা পুরুষোত্তম ব্রত পালন করনি। এই মাস বৃন্দাবন চন্দ্রের অতীব প্রিয়। এই মাসব্রত খুবই দুর্লভ। এজন্যই তোমরা দুঃখ পাচ্ছ। তোমরা ব্যাসদেবের উপদেশে সমস্ত বর্ণাশ্রমোচিত আচার পালন করেছ। কিন্তু পুরুষোত্তম মাসের পূজা না করা পর্যন্ত, আমাতে শুদ্ধভক্তি লাভ করতে পারবে না।”
দ্রৌপদীর পূর্ব জন্মের ইতিহাস-
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলতে লাগলেন, “আমি এখন দ্রৌপদীর পূর্ব জন্ম বৃত্তান্ত বলব। পূর্বজন্মে দ্রৌপদী মেধা ঋষির কন্যা ছিলেন। | বাল্যেই তার মাতৃবিয়োগ হয়। তাই পিতার তত্ত্বাবধানেই পালিত হয়েছিলেন। দিনে দিনে, তিনি যৌবনা অবস্থাপ্রাপ্ত হলেন। তিনি খুবই সুন্দরী ছিলেন; কিন্তু তার পিতা বিয়ের কোনো বন্দোবস্তই করতে আগ্রহী ছিলেন না। বান্ধবীদের পতি-পুত্রসহ সুন্দর | সংসার দেখে তার দুশ্চিন্তা আরও বৃদ্ধি পেল। হঠাৎ একদিন তার পিতৃদেব দেহত্যাগ করলেন। এতে তার অবস্থা আরও শোচনীয় হলো। সৌভাগ্যবশত দুর্বাসা মুনি সেখানে এলেন।
মহান মুনিকে দর্শন করে তিনি প্রণতি নিবেদনকরত পূজা সম্পাদন করলেন। তিনি মুনিবরকে সুগন্ধি পুষ্প ও ফলমূল নিবেদন করলেন। দুর্বাসা মুনি আশীর্বাদ দিতে উদ্যত হলে, | তিনি ক্রন্দন করতে আরম্ভ করেন। মুনিবর তার শোকের কারণ জানতে চাইলেন । সেই ব্রাহ্মণ কন্যা বলতে লাগলেন, “হে | দ্বিজশ্রেষ্ঠ, আপনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সবই জানেন। এ জগতে আমার কোনো আশ্রয়দাতা নেই। আমার সমস্ত | আত্মীয়-স্বজন গত হয়েছে। আমার পিতা, কিংবা বড় কোনো ভ্রাতা নেই। আমার স্বামীও কিংবা বড় কোন ভ্রাতা নেই, যে আমায় রক্ষা করবে।
হে মুনিবর, আমাকে এসমস্ত দুঃখ থেকে মুক্তি প্রদান করুন। প্রার্থনা শ্রবণান্তে তাঁর অবস্থা বিবেচনা করে দুর্বাসা মুনি তাকে কৃপা করতে মনস্থ করলেন। দুর্বাসা মুনি বললেন, "হে সুন্দরী, আগামী তিন মাসের মধ্যে পরম পবিত্র পুরুষোত্তম মাস শুরু হবে। এই পবিত্র মাসটি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিকটে সবচেয়ে প্রিয়। এই মাসে কেবল একবার মাত্র পুণ্যস্নান করার মাধ্যমেই যে কোনো নর-নারী সমস্ত পাপ হতে মুক্তি লাভ করতে পারে। এই মাস সকল মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। অন্য সমস্ত মাসের মহিমা এই মাসের এক ষোড়শাংসেরও (১/১৬) সমান নয়। এই মাসে এমনকি একবার স্নান করলেও তা ১২০০ বছর ধরে গঙ্গাতে স্নানের সমান ফল হয়ে থাকে। যা বৃহস্পতি সিংহ রাশিতে প্রবেশ করলে গঙ্গা বা গোদাবরীতে স্নানের সমান ফল হয়ে থাকে।
যদি তুমি এই মাসে কেবল একবার স্নান কর, দান কর এবং কৃষ্ণ নাম কর তবে তোমার সমস্ত দুঃখ-দুর্দশা দূর হবে। তুমি সর্বসিদ্ধ লাভ করবে এবং তোমার সকল মনোবাসনা পূর্ণ হবে। দয়া করে আমার উপদেশ অনুসরণ কর। দয়া করে আসন্ন পুরুষোত্তম মাসকে যত্ন সহকারে পূজা করতে ভুলো না। এই কথাগুলো বলার পর দুর্বাসা ঋষি নীরব রইলেন”। | দুর্ভাগ্যবশত যুবতী ব্রাহ্মণী তাঁর কথায় বিশ্বাস করলেন না। বরং তিনি ক্রোধান্বিত হলেন এবং নিন্দা করতে লাগলেন। হে মহামুনি, আপনি মিথ্যা বলছেন। কীভাবে এই অতিরিক্ত মাসটি, যাকে মলমাস বলা হয় তা অন্য সব মাস এমনকি | কার্তিক, মাঘ বা বৈশাখ মাস থেকেও শ্রেষ্ঠ হবে।
আমি আপনার কথা বিশ্বাস করি না। আপনি আমাকে প্রতারিত করার চেষ্টা করছেন। এই অতিরিক্ত মাস সকল ধরনের পারমার্থিক কার্যকলাপ অনুষ্ঠানের জন্য সবচেয়ে ঘৃণ্য বলে মনে করা হয়। | ব্রাহ্মণ বালিকার এই সমস্ত কথা শ্রবণ করে দুর্বাসা ঋষি ক্রোধান্তিত হলেন। তার সারা শরীর জ্বলতে লাগল, চোখ তাম্রগোলকের ন্যায় লাল হয়ে গেল। কিন্তু বালিকাটির অসহায় অবস্থা চিন্তা করে নিজেকে সংবরণ করে বললেন, “রে দুর্মতি। তোর পিতা আমার বাল্যবন্ধু, তাই তোকে অভিশাপ দিচ্ছিনা তদুপরি, এখন তোর নিতান্ত করুণ অবস্থা।
মূর্খেরা বৈদিক সিদ্ধান্ত হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না। আমার প্রতি দুর্ব্যবহারের জন্য কোন অপরাধ নিচ্ছি না। কিন্তু পুরুষোত্তম মাসের প্রতি অবহেলার কোনো নিস্তার নেই। আগামী জন্মে অবশ্যই এর ফল ভোগ করতে হবে।” দুর্বাসা মুনি তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে প্রস্থান করলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তখন অর্জুনকে বললেন, “হে অনঘ দুর্বাসা মুনি চলে যাবার সাথে সাথে ব্রাহ্মণ কন্যা তার সমস্ত ঐশ্বর্য হারাল। পুরুষোত্তম মাসের প্রতি অপরাধের ফলে সে কুৎসিত দেহ ধারণ করল। তাই ভগবান আশুতোষের (শিব) আরাধনা করতে মনস্থ করল।”
সেই ব্রাহ্মণী তখন উমাপতির ধ্যানে মগ্ন হলেন। দীর্ঘ নয় হাজার বছর তপস্যার পর ভগবান শিব তার নিকট আবির্ভূত হলেন। ভগবান শিবের দিব্যরূপ দর্শন করে, সে পুনঃ যৌবন প্রাপ্ত হলো। শিবের উপস্থিতির ফলে দৈহিক বৈকল্যও দূর হলো। তাকে আবারো পূর্বের মতো দেখতে লাগল। সে শিবকে কাছে পেয়ে বৈদিক মন্ত্রাদিতে তাঁর স্তব করতে লাগল । | কন্যাটির প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে শিব বললেন, “হে তপস্বিনী, সৌভাগ্যবতী হও। তুমি বর কামনা কর। আমি তোমার তপস্যায় সন্তুষ্ট। তুমি যা ইচ্ছা চাইতে পার।” শিবের মুখপদ্ম থেকে এসব বাণী শুনতে পেয়ে সে বলল, “হে দীনবন্ধু, আমাকে গুণবান স্বামী প্রদান করুন। এই কথাটি সে পরপর পাঁচবার বলল। ভগবান শিব তখন বলল, “যেহেতু তুমি পাঁচবার এই | কথাটি বলেছ, তাই তোমার পঞ্চস্বামী হবে।”
ভগবান শিবের বাক্য শ্রবণ করে অত্যন্ত লজ্জিত হলো। তিনি | বললেন, “হে ভগবান! একজন কন্যার পাঁচ স্বামী থাকাটা খুবই ঘৃণার হয়। দয়া করে আপনার বাক্য ফিরিয়ে নিন।” ভগবান শিব তখন গম্ভীরভাবে বললেন, এটা আমার পক্ষে অসম্ভব। তুমি আমার কাছে যা চেয়েছ তা অবশ্যই পাবে। তুমি পরবর্তী জন্মে | পাঁচজন স্বামী পাবে। পূর্বে তুমি দুর্বাসা মুনির করুণাপূর্ণ উপদেশ না মেনে পুরুষোত্তম মাসকে অবজ্ঞা করে অপরাধ করেছ। হে ব্রাহ্মণী! দুর্বাসা ও আমার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে ব্রহ্মাদিসহ সকল দেবতা ও নারদ মুনিসহ | সকল ঋষিরা এই পুরুষোত্তম ব্রত পালন করে। পুরুষোত্তম ব্রত পরায়ণ ভক্ত এই জীবনে সকল সৌভাগ্য অর্জন করেন এবং জীবনান্তে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ধাম গোলোক বৃন্দাবনে প্রত্যাবর্তন করেন।
এই পুরুষোত্তম মাসের প্রতি অপরাধ করার ফলে তুমি পরবর্তী জীবনে পাঁচ স্বামী পাবে। বালিকাটি বিষণ্ণ হলো; কিন্তু ভগবান শিব তখনই অদৃশ্য হলেন। শিবের অন্তর্ধানের পর পরবর্তী জীবনের কথা ভেবে ব্রাহ্মণী খুবই বিষণ্ণ এবং ভয়ে ভীত হলেন। এইভাবে চিন্তা করতে করতে কিছুদিন পর ব্রাহ্মণী মারা গিয়েছিল। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলতে লাগলেন, “হে অর্জুন! ইতোমধ্যে রাজা দ্রুপদ একটি যজ্ঞানুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। সেই যজ্ঞানুষ্ঠানে যুবতী ব্রাহ্মণীটি মহারাজ দ্রুপদের কন্যা হিসেবে আবির্ভূত হলেন ।
হে অর্জুন! সেই মেধা ঋষির কন্যাই দ্রৌপদী হিসেবে জগদ্বিখ্যাত হয়েছে। তিনি তোমাদের বর্তমান স্ত্রী থেকে ভিন্ন নয়। যেহেতু পূর্ববর্তী বালিকাটি জন্মে পুরুষোত্তম মাসের নিন্দা করেছিল। | তাই সে কুরুসভায় তার পঞ্চস্বামীর সামনেই দুঃশাসেন দ্বারা অপমানিত হয়েছিল। সৌভাগ্যবশত সে আমাকে স্মরণ করেছিল এবং আমার আশ্রয় নিয়েছিল। অপরাধ ক্ষমা করে আমি তাকে সবচেয়ে লজ্জাজনক পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করে দুঃশাসনের হতে থেকে রক্ষা করি। হে পাণ্ডবগণ ভুলো না। যে ব্যক্তি পুরুষোত্তম মাসের নিন্দা করবে সে কখনো সৌভাগ্য লাভ করবে না। তাই পুরুষোত্তম মাস তোমাদের সকল ইচ্ছা পুরণে এবং সব দুঃখ দূরীকরণে সমর্থ। এখন তোমাদের চৌদ্দ বছরের বনবাস শেষ হতে চলেছে। তাই নিষ্ঠার সাথে এই ব্রত অনুষ্ঠান কর যাতে সকল সৌভাগ্য লাভ করতে পার। এইভাবে | পাণ্ডবদেরকে সান্ত্বনা প্রদান করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন ।
কিছুদিন পরে পুরুষোত্তম মাসের আগমন ঘটলে যুধিষ্ঠির মহারাজ তার অনুজ ভাইদের এবং দ্রৌপদীকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের | কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। তারা সকলেই তাঁর (শ্রীকৃষ্ণের) নির্দেশ পালন করলেন। তারা এই পবিত্র মাসে বিভিন্ন উপায়ে পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেবা করলেন। এই ব্রত প্রভাবে তারা তাদের হারানো সাম্রাজ্য ফিরে পেয়েছিলেন এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন অতিবাহিত করার পর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কৃপায় তারা ভগবদ্ধাম প্রাপ্ত হয়েছিলেন ।
একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তির উচিত, কোনো শুদ্ধভক্তের মুখনিঃসৃত কৃষ্ণ কথা শ্রবণে নিজেকে নিয়োজিত করে, সর্বদা শ্রীকৃষ্ণের চিন্তা করা ও তার লীলাবিলাস সম্বন্ধে অন্য ভক্তদের নিকট আলোচনা করা। হৃদয়ে সর্বদা কৃষ্ণচিন্তা করার মাধ্যমে তৃপ্ত হওয়া উচিত। যদি কেউ গৃহস্থ হন তবে তার সৎ ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে গৃহস্থালি দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করা উচিত। তার কোনো রকম বিবাদে জড়ানো উচিত নয় এবং সাধু ও দরিদ্রদের প্রতি দয়ার্দ্র হওয়া উচিত। গোরক্ষা, সদালাপ, দয়া এবং অহিংসা-এই গুরুত্বপূর্ণ নিয়মগুলো গৃহস্থদের অনুসরণীয় হওয়া উচিত।
সুত গোস্বামী নৈমিষারণ্যের ঋষিদের সম্মুখে ভগবান | নারায়ণ ও নারদমুনির এই কথোপকথন বর্ণনা করে চললেন। তিনি বললেন, “হে ব্রাহ্মণগণ! ভগবান নারায়ণের নিকট এই পুরুষোত্তম মাসের মহিমা শ্রবণ করে নারদমুনি অত্যন্ত প্রীত হলেন। তিনি বারবার দণ্ডবৎ প্রণতি নিবেদন পূর্বক বলতে লাগলেন,
এই পুরুষোত্তম মাস সকল মাসের মধ্যেই শ্রেষ্ঠ। এটা সকল ব্রত ও তপস্যার মধ্যেও শ্রেষ্ঠ। এমনকি যদি কেউ ভক্তিভরে কেবলমাত্র এই ব্রত মাহাত্ম্য শ্রবণ করে, তবে সে অচিরেই ভগবৎ সেবা লাভ করে এবং তিনি তৎক্ষণাৎ সকল পাপ কর্মফল থেকে মুক্ত হন। পুরুষোত্তম ব্রত পালন প্রভাবে অচিরেই সকল | সৌভাগ্য লাভ করে গোলোক বৃন্দাবনে গমন করেন। নারদ মুনি এরপর ভগবান নারায়ণকে বলতে লাগলেন, “হে ভগবান, এখন আমার হৃদয় ও মন সম্পূর্ণভাবে তৃপ্ত হলো। তোমার জয় হোক।
এইভাবে পুরুষোত্তম মাসের মহিমা বর্ণনা করার পর গঙ্গাস্নান ও অন্যান্য কৃত্যাদি সম্পাদন করার জন্য সুত গোস্বামী সমবেত সকল মুনিদের নিকট প্রার্থনা নিবেদন করলেন। তারা কৃতজ্ঞতার সহিত সম্মত হলো এবং তিনি তখন তাঁদের প্রণতি নিবেদন করে গঙ্গাস্নানে গেলেন। নৈমিষাণ্যের ঋষিরা তখন পরস্পর বলতে লাগলেন। “ওহ্! এই পুরুষোত্তম মাস সবচেয়ে | মহিমাপূর্ণ এবং এর ইতিহাস অতি প্রাচীন। এটা কল্পতরুর মতো ভক্তদের সমস্ত বাসনা পুরণে সমর্থ। পুরুষোত্তম মাসের জয় হোক।”