ভগবানের প্রসাদ কেন গ্রহণ করা উচিত? Why should God accept Prasad? What is Prasad?

ভগবানের প্রসাদ কেন গ্রহণ করা উচিত? Why should God accept Prasad? What is Prasad?

ভগবানের প্রসাদ- ভগবানের প্রসাদ বলতে আমরা বুঝি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে নিবেদিত খাদ্য দ্রব্য কে বুঝায়। অর্থাৎ আমরা যা গ্রহণ করব সেই খাদ্যদ্রব্য গুলি তুলসী পত্রের সহিত ভগবানকে নিবেদিত করলেই তা প্রসাদ বলে গণ্য হয়।   

 

     ভগবদ্‌গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন যে , যারা আমাকে নিবেদন না করে খাদ্য গ্রহণ করে তারা পাপ ছাড়া আর কিছুই ভক্ষণ করে না। আর যারা ভগবানকে নিবেদিত খাদ্যের অবশিষ্টাংশ গ্রহণ করে তারা সকল পাপমূলক প্রতিক্রিয়া হতে মুক্ত থাকে। শরীর রক্ষার জন্য আমাদের সকলকে আহার গ্রহণ করতে হয়। তাই যিনি আমাদের সবকিছু দিয়েছেন তাঁকে প্রথমে খাদ্য নিবেদন করা উচিৎ । এটা পরীক্ষিত সত্য যে, ভগবানের উদ্দেশ্যে নিবেদিত খাদ্য অর্থাৎ প্রসাদের বিশেষ ধরনের স্বাদ হয়। যা অত্যন্ত বিলাসবহুল রেস্তোরাঁর খাবারেও এ স্বাদ পাওয়া যায়না। প্রসাদ গ্রহণ করার ফলে মানুষের গোটা অস্তিত্ব পবিত্র হয়ে যায় এবং স্বাস্থ্য ভাল থাকে । ঈশ্বরের আশীর্বাদসূচক এই অভিজ্ঞতা ভক্তির বহিঃপ্রকাশ । শুধুমাত্র মহাঋষিদের ভুক্তাবশেষ ভক্ষণ করে এক চাকরাণীর পুত্র পরজন্মে নারদ মুনি হয়েছিলেন। প্রসাদের গুণ এত ব্যাপক । 

 

   বেদে বলা হয়েছেঃ  “আহার শুদ্ধৌ সত্ত্ব-শুদ্ধিঃ”  । যদি কারও আহার শুদ্ধ হয়, তাহলে তার সমগ্র চেতনা শুদ্ধ হয়ে ওঠে । 

 

     ঐতিহ্যগতভাবে যাঁরা বৈদিক সংস্কৃতির অনুগামী ছিলেন, তাঁরা তাঁদের আহারের বিষয়ে অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। কারণ, আহার্য যিনি রন্ধন বা প্রস্তুত করেন, তার চেতনা খাদ্যে সঞ্চারিত হয়। তাই ভক্তরা যদি এমন সব ব্যক্তির রান্না করা খাবার আহার করেন যাদের চিত্ত ও ব্যবহার দূষিত, তাহলে তাদের চেতনাও কলুষিত হয়ে পড়বে-অজান্তে রাধুনীর মানসিকতা আহারকারীদের চেতনায় সঞ্চারিত হবে । এই সঙ্গে রন্ধনকারীর পাপকর্মফলও ভোগ করতে হয় ।  

 

    শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেছেন- 

 

                                               বিষয়ীর অন্ন খাইলে মলিন হয় মন ।   

                                               মলিন মন হৈলে নহে কৃষ্ণের স্মরণ ॥ 

 

সেজন্য ভক্তরা কেবল কৃষ্ণপ্রসাদ গ্রহণের অভ্যাস করেন ।    (চৈতন্যচরিতামৃত, অন্ত্য, ৬-২৭৮) 

 

     প্রসাদ শুধু যে কর্ম ফলের  বন্ধনমুক্ত করে তাই নয়, কৃষ্ণপ্রসাদ চেতনাকে কলুষমুক্ত ও বিশোধিত করে। কেননা, কৃষ্ণভাবনাময় ভক্তদের দ্বারা প্রেম ও ভক্তির সাথে সেই খাবার রান্না করা হয়েছে ও শ্রীকৃষ্ণে নিবেদিত হয়েছে। কৃষ্ণভক্তিতে দ্রুত উন্নতি সাধন করতে হলে আহারের ক্ষেত্রে কঠোরতার আবশ্যকতা রয়েছে। সবচেয়ে ভাল হচ্ছে জীবনধারাকে এমন ভাবে নিয়ন্ত্রিত করা, যাতে সর্বদা কেবল কৃষ্ণপ্রসাদ গ্রহণ করা সম্ভব হয় । 

 

     অবশ্য সব ভক্তের পক্ষে এমনটা করা সবসময় সম্ভব নাও হতে পারে। কোন কর্মব্যস্ত মানুষ, কিংবা যাকে প্রায়ই বাইরে ঘুরতে হয়, তাঁরা অনেক সময় বাইরের খাবার কিনে খেতে বাধ্য হন । যদি খাবার কিনতেই হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে সবচেয়ে ভাল হচ্ছে  ফল, চিড়া, মুড়ি ও শুকনো জাতীয় খাবার কেনা।  দুধ ও দুধের তৈরী খাবার ও (দই, মিষ্টি, পনির, ছানা ইত্যাদি) কেনা যেতে পারে; কারণ অভক্তদের দ্বারা তৈরী হলেও দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য সব সময় শুদ্ধ থাকে । বাইরের রেস্তোঁরায় কোনরূপ আহার গ্রহণ ভক্তদের পক্ষে অনুচিত। 

 

     সম্প্রতি ভারতজুড়ে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হচ্ছে যে ডিম হল একটি নিরামিষ খাদ্য । জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিতে নিষিক্ত (fertilized) ডিম হল ভ্রূণ (যা আসলে তরল মাংস); আর অনিষিক্ত (Unfertilized) ডিম হল মুরগীর রজঃস্রাব  (menstruation) । শাস্ত্রে স্পষ্টতঃই ডিমকে আমিষ খাদ্য বলা হয়েছে। সেজন্য তথাকথিত সব বিজ্ঞানী, রাজনৈতিক বা ডিম বিক্রেতাগণের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারে বিভ্রান্ত হওয়া উচিত নয় । 

 

     কর্মফলের নিয়ম অনুসারে অভক্তদের রান্না করা খাদ্যবস্তু বিশেষভাবে কলুষিত, কেন না, ভগবানকে অর্পিত না হওয়ার জন্য তা আমাদের কর্মফলের বন্ধনে আবদ্ধ করে । সেজন্য তাঁদের তৈরী ভাত-রুটি মাঝে মধ্যে আহার করলে তা ভক্তিলাভের প্রতিবন্ধক হবে। 

 

     বাজারে কেনা সোয়াবিন বড়ি  রান্নার ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে । অনেকে মনে করে যে তাতে ভক্তির প্রতিকূল দ্রব্য মেশানো থাকে। সন্দেহ জনক খাদ্যের ব্যাপারে ভক্তগণের সতর্ক থাকা উচিৎ। যদি সোয়াবিন খেতেই হয় তা'হলে সোয়াবিন বীজ কিনে জলে ভিজিয়ে গ্রাইন্ডিং করে বড়া বানিয়ে সব্জি তৈরী করে ভগবানকে ভোগ লাগিয়ে গ্রহণ করা যায় । 

 

     পেঁয়াজ, রসুন ও মধুরডাল আহার করা ভক্তদের সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ । এগুলো শ্রীকৃষ্ণকে নিবেদনযোগ্য নয়। এগুলো আহার করলে জড়া প্রকৃতির নিকৃষ্টতমগুণ তমোগুণে চেতনা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। 

 

     এমন কি  চা কফির মত হাল্কা নেশাও বর্জনীয়,  কেননা, এগুলি স্বাস্থ্যের প্রতিকূল, অপরিচ্ছন্নতাযুক্ত এবং অনাবশ্যক। এগুলো বদভ্যাস গড়ে তোলে। আর চা-কফি কখনো ভগবানকে নিবেদনও করা যায় না । 

 

     চকলেটে ক্যাফিন থাকে, তাই এটিও এক ধরনের  লঘু মাদকদ্রব্য । চকলেট অস্বাস্থ্যকর, কারণ এতে রক্ত দূষিত হয় ও শরীরে কালো ছাপ পড়তে পারে; আর চকলেট নিবেদনযোগ্যও নয়। কিছু ভক্ত অবশ্য চকলেট খাওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন, তবু এ-ব্যাপারে রক্ষণশীল হওয়াই ভাল । চকলেট ছাড়াই আমরা বেঁচে থাকতে ও কৃষ্ণভাবনা অর্জনের পথে এগিয়ে যেতে পারি। আর চকলেটকে খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা তো কৃষ্ণের সন্তুষ্টিবিধানের জন্য নয়, কেবল আমাদেরই ইন্দ্রিয় তৃপ্তির জন্য — তাই না? 

 

     অভক্তদের তৈরী বাজারের নিরামিষ খাদ্য-দ্রব্যাদি সম্পর্কে ভক্তদের খুব সতর্ক হওয়া উচিত । যেমন  বাজারের রুটি, বিস্কুট, আইসক্রীম, কেক আদি খবার গুলিতে প্রায়ই ডিম থেকে তৈরী একরকম উপাদান থাকে। কখনও কখনও খাবারের প্যাকেটের উপর লেখা উপাদানের তালিকায় বিভিন্ন সব রাসায়নিক দ্রব্যের নাম লেখা থাকে। এসব খাবার নিরামিষ হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। এরকম ক্ষেত্রে এগুলো এড়িয়ে চলাই ভাল । 

 

     আসল কথা হল, যেভাবেই হোক কেবলমাত্র কৃষ্ণপ্রসাদ গ্রহণ করার নীতিতে অবিচলিত থাকতে হবে-সেটাই সর্বোত্তম। বর্তমান যুগের মানুষ রান্নার কাজে খুব অলস হয়ে পড়েছে; কিন্তু বাড়ীতে রান্না খাবার সর্বতোভাবে দৈহিক সুস্বাস্থ্যের সহায়ক, পারমার্থিক স্বাস্থ্যের তো কথাই নেই ।